দিয়ে তুলতে ভুলে গিয়েছে কেউ। শূন্য টিকিট কাউন্টারের পাশ দিয়ে ঢুকতেই দেখি, অস্থায়ী গুমটির সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে চেয়ার। টেবিলে রাখা প্লেটে দু’দিনের বাসি খাবার। কিছুটা এগোতেই সবুজ গালিচায় রক্তের ধারা গড়িয়ে গিয়ে শুকিয়ে কালচে হয়ে রয়েছে। এক জওয়ান জানালেন, ওখানেই মৃত স্বামীর পাশে বসেছিলেন সদ্য বিবাহিত স্ত্রী— রক্তাক্ত পহেলগামের মুখ হয়ে উঠেছে যে ছবি। আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কাদামাখা জুতো, টুপি, মাফলার, চশমা। চারপাশে ঘিরে রয়েছে পাইনের জঙ্গল। খাড়া উঠে গিয়েছে পিরপঞ্জাল পাহাড়। ওই জঙ্গল থেকেই বেরিয়েই মঙ্গলবার পর্যটকদের উপরে হামলা চালায় জঙ্গিরা।
তবে মিনিট পাঁচেকও যায়নি, হঠাৎ কার্বাইন হাতে উপস্থিত জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের জওয়ানেরা। নির্দেশ— দ্রুত নেমে যেতে হবে নীচে। আজ সকাল থেকেই জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-এর অফিসারেরা ঘাঁটি গেড়েছিলেন বৈসরনের হামলাস্থলে। হামলার পরে পিরপঞ্জাল পাহাড় ধরে জঙ্গিরা এক দিকে কিশতোয়ার, অন্য দিকে বালতাল ও সোনমার্গে চলে গিয়েছে বলে দু’দিন ধরে জানানো হলেও আজ বেলা গড়াতেই বৈসরন সংলগ্ন জঙ্গলে সন্দেহজনক গতিবিধির আভাস পায় নিরাপত্তাবাহিনী। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের পদস্থ কর্তা ফৈজান আলি পাহাড়ি পথে উঠে এসে হাঁফাচ্ছিলেন। কোনও মতে বললেন, ‘‘দ্রুত নীচে নামুন। আশেপাশের জঙ্গলে তল্লাশি শুরু হয়েছে। এলাকার দখল নেবে সেনা। গুলি-গোলা চলতে পারে। নেমে যান।’’
নামার পথেই দেখতে পেলাম, রাস্তার দু’ধারে ‘টু বাই টু’ ধাঁচে জায়গা নিচ্ছেন জওয়ানেরা। শুরু হয়েছে ‘এরিয়া ডমিনেশন।’ নামার পথেই খবর এল আগামিকাল শ্রীনগর আসছেন সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। কাশ্মীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে বৈঠক করবেন শীর্ষ সেনা কর্তাদের সঙ্গে। আসতে পারেন পহেলগামেও। তাঁর আসার সম্ভাবনা থাকায় এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠে নেমে পড়েছে সেনা।
সূত্রের দাবি, ঘটনার দিন চার থেকে ছ’জন জঙ্গি ঘটনাস্থলে ছিল। যাদের মধ্যে দু’জন স্থানীয় বলে আপাতত জানা গিয়েছে। এদের বাড়ি সম্ভবত বিজবেহরা ও কুলগামে। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়দের দাবি, বাকি চার জন জঙ্গি নিজেদের মধ্যে যে ধাঁচের উর্দুতে কথা বলছিল তা মূলত পাক অধিকৃত কাশ্মীরেই বলা হয়। ঘটনার দিন ওই জঙ্গিরা মূলত তিনটি স্থান থেকে পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। মাত্র দশ মিনিটে হত্যালীলা শেষ করে জঙ্গলে মিলিয়ে যায় তারা। সূত্রের মতে, ওই জঙ্গিদের সকলের ভেস্টে ক্যামেরা (বডি ক্যাম) লাগানো ছিল। যা মূলত প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখার জন্য ব্যবহার হয়। যাতে তা পরবর্তী সময়ে নিজেদের সাফল্য প্রচারে কিংবা প্রশিক্ষণের সময়ে ব্যবহার করা যায়।
গোড়া থেকেই যে প্রশ্ন উঠেছে, তা হল বিপুল পর্যটকের উপস্থিতি সত্ত্বেও কোনও নিরাপত্তাবাহিনী কেন ছিল না সেখানে? যে কারণে অনায়াসে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে হামলা চালিয়ে ফের জঙ্গলে মিলিয়ে যায় ওই জঙ্গিরা। আসলে দীর্ঘ সময় ধরে ওই এলাকায় নজর রেখে জঙ্গিরা বুঝেছিল, হামলা হলে সামান্য প্রত্যুত্তরের সম্ভাবনা নেই। পাহাড়ের নীচেই রয়েছে সিআরপিএফের ১১৬ ব্যাটেলিয়ন। সূত্রের মতে, ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত বৈসরনে এক কোম্পানি আধা সেনা নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন ছিল। কিন্তু অশান্তি না হওয়ায় বছর দু’য়েক আগে কাশ্মীরের অন্য প্রান্তে পাঠানো হয় ওই বাহিনীকে। ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়ে বৈসরন। যার মূল্য দিল ২৬টি প্রাণ।
উৎরাই পেরিয়ে যখন পহেলগামের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছলাম, গোটা এলাকার দখল নিয়েছে সেনাবাহিনী। নামার
পথেই দেখছিলাম অসমতল, বন্ধুর পথে ছুটে চলেছে একের পর এক সাঁজোয়া গাড়ির কনভয়। নীচেও প্রায় এক ছবি। দু’হাত দূরে সেনা ও সেনার বিস্ফোরক নিরোধক গাড়ি। বলা হল, দ্রুত এলাকা খালি করে দিতে। ঝুঁকি নিলেন না স্থানীয়রাও। পা বাড়ালেন ঘরের দিকে।
সকালের আপাতশান্ত পহেলগামের মুখ তাই বিকেল হতেই থমথমে, শুনশান। সঙ্গী শুধু আতঙ্ক।