প্রকল্পের আওতায় যে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। কমানো হচ্ছে পাক দূতাবাসের কর্মী সংখ্যা। এখানেই শেষ নয়। বৃহস্পতিবার ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক জানিয়ে দেয়, শুধু সার্ক ভিসা নয়, মেডিক্যাল ভিসা-সহ পাক নাগরিকদের জন্য সব রকম ভিসাই বাতিল করা হচ্ছে। মেডিক্যাল ভিসা কার্যকর থাকবে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত, বাকি ভিসা কার্যকর থাকবে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। অর্থাৎ মাস শেষ হওয়ার আগেই সব পাকিস্তানি নাগরিককে ভারত ছাড়তে হবে। পাক সরকারের এক্স হ্যান্ডলও ভারতে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এমনিতে দাবি করা হচ্ছিল, পহেলগামের ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনও যোগ নেই। যা ঘটেছে, স্থানীয় ভাবেই ঘটেছে। ভারত কূটনৈতিক আঘাত হানার পরে আজ পাল্টা জবাবের রাস্তা নিয়েছে পাকিস্তানও। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের উপস্থিতিতে আজ বৈঠকে বসে পাক জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ। তার পরেই বিবৃতি দিয়ে দাবি করা হয়, ভারতের কূটনৈতিক পদক্ষেপ সমূহ ‘‘একতরফা, অন্যায়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং আইনি বৈধতারহিত।’’ বিশেষ করে সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত ঘোষণার জেরে সিন্ধুর জল যদি আটকানো হয় বা জলের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, সেটা পাকিস্তান ‘যুদ্ধ’ হিসাবে দেখবে এবং ‘সর্বশক্তি’ দিয়ে তার মোকাবিলা করবে বলে জানানো হয়। চুক্তি অনুসারে, পাকিস্তান সিন্ধু নদীর প্রায় ৮০% জল পায়, যা সে দেশের খাদ্য উৎপাদন এবং জনসংখ্যার জীবিকার জন্য অপরিহার্য। যদিও সিন্ধুর জলের মুখ ঘুরিয়ে দিতে হলে ভারতকে পরিকাঠামোগত এত বড় পরিবর্তন করতে হবে যে, এই হুঁশিয়ারির বাস্তবায়ন নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশক দার-এর আগামী রবিবার বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার কথা ছিল। ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি’র উদ্ভবের কারণে সেই সফর স্থগিত করে দিয়েছেন তিনি। সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি বলেছেন, ‘‘পাকিস্তানকে দোষারোপ করা ভারতের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। পহেলগামের ঘটনায় পাকিস্তানের হাত আছে, এমন কোনও তথ্যপ্রমাণ থাকলে ভারত দেখাক।’’
এর পরে ভারতের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ পদক্ষেপ ঘোষণা করে পাকিস্তান। তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে, ভারতের সঙ্গে সব রকম দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত রাখার অধিকার তারা প্রয়োগ করবে। এর মধ্যে শিমলা চুক্তিও যে অন্তর্ভুক্ত, সে কথা উল্লেখ করা হয় আলাদা করে। দাবি করা হয়, এই পদক্ষেপ তত দিন অবধি জারি থাকবে, যত দিন না ‘ভারতের তরফে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসে উস্কানি’ দেওয়া বন্ধ হয়। মনে রাখা যেতে পারে, ১৯৭২ সালে শিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে। সেখানে ১৯৭১-এর যুদ্ধের সংঘর্ষবিরতি রেখাকে কার্যত জম্মু-কাশ্মীর সীমান্ত বলে মেনে নেওয়া হয়— ওই ভৌগোলিক সীমানাই নিয়ন্ত্রণরেখার স্বীকৃতি পায়। দু’পক্ষই ওই স্থিতাবস্থা মেনে চলবে এবং কেউই একতরফা ভাবে ওই সীমানা বদল করার চেষ্টা করবে না বলেও স্থির হয়। এখন শিমলা চুক্তি স্থগিত হয়ে যাওয়া মানে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণরেখার মান্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাওয়া, মনে করছে কূটনৈতিক মহল।
তবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক এ নিয়ে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে পাকিস্তানের গতিবিধির উপরে সতর্ক নজর রাখা হয়েছে। ভারতীয় কূটনীতিকদের মতে, আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টাতেই পহেলগামের ঘটনা ঘটিয়েছে পাকিস্তান। কাশ্মীর প্রশ্নে তারা আন্তর্জাতিক মহলে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছিল, তাদের হতাশা বাড়ছিল। এমতাবস্থায় নরেন্দ্র মোদীর সৌদি সফর এবং আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতি জে ডি ভান্সের ভারত সফরের সময়টাকে নজর করেই পাক জঙ্গিরা পহেলগামে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ঘটনার পরে সারা বিশ্ব যে ভাবে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে পাকিস্তানের কোনও সুবিধাই হয়নি।
দ্বিপাক্ষিক সব রকম চুক্তি স্থগিত করার পাশাপাশি আজ অপরাপর কূটনৈতিক পদক্ষেপও ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। যেমন, পাকিস্তানের আকাশসীমা ভারতীয় বিমান চলাচল বন্ধ করা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সব রকম বাণিজ্য এবং পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে তৃতীয় কোনও দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদানপ্রদান বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে। ওয়াগা পোস্ট দিয়ে ভারতীয় পণ্য চলাচল বন্ধ। শিখদের জন্য ধর্মীয় ভিসা বাদে ভারতীয়দের জন্য সার্ক ভিসা বাতিল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সার্ক ভিসাধারী ভারতীয়দের পাকিস্তান ছাড়তে হবে। ওয়াগা দিয়ে আসা ভারতীয় ভিসাধারীদের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ভারতে ফিরতে হবে। ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা কমানো হবে। পাকিস্তানে অবস্থানকারী ভারতের প্রতিরক্ষা, নৌবাহিনী এবং বায়ুসেনা আধিকারিকদের ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ বা ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ বলে গণ্য করা হবে। তাঁদেরও ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ভারতে ফিরতে হবে।
ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে এদিন বিক্ষোভ দেখান স্থানীয়রা। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে আরব সাগর অঞ্চলে সামরিক নজরদারি বাড়িয়েছে পাকিস্তান। শুরু হয়েছে নৌমহড়া। ভূমি থেকে ভূমিতে ছোড়ার একটি ক্ষেপণাস্ত্রও আজ-কালের মধ্যে পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে পাক সরকার। সংবাদ সংস্থা