আজ যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উতল হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাপনের প্রতিটি স্পন্দন, জীবনযাত্রায় এআই-এর পূর্ণ দখলদারি যখন অনিবার্য, ভেবে দেখি, আমার মতো অনেক বাঙালিরই এআই-এর সঙ্গে প্রথম পরিচয় সত্যজিতের হাত ধরে— ছেলেবেলায়, না বুঝেই। সেটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবিক বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় প্লাবন আনার কমবেশি আধ শতক আগেই।
মূলত প্রোফেসর শঙ্কুর কর্মকাণ্ডের রংচঙে মোড়কে, এবং তার বাইরেও, কল্পবিজ্ঞানের একটা স্বতন্ত্র রূপরেখা বাঙালি পাঠককে উপহার দিয়েছেন সত্যজিৎ। মেরি শেলির ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’, রবার্ট লুই স্টিভেনসনের জেকিল-হাইড কিংবা এইচ জি ওয়েলসের ‘টাইম মেশিন’-এর মতো পাশ্চাত্যের আধুনিক সংবেদনশীলতার সঙ্গে প্রাচ্যের প্রাচীন জ্ঞানচর্চার পরিমিত মিশেল ঘটিয়ে। ঔপনিবেশিকতার বল্কল খসিয়ে জয়যাত্রার সুস্পষ্ট ঘোষণার একটা এক সুপ্ত অভীপ্সাও হয়তো কোথাও ছিল সত্যজিতের শঙ্কুর অভিযানগুলোতে। উত্তর-ঔপনিবেশিকতার এই জয়গান ঘনাদার গল্পেও ছিল। তবে সত্যজিতের শঙ্কুর গল্পগুলি এক জন বিজ্ঞানীকে উপস্থাপন করে নায়ক হিসেবে, বেশি জোর দেয় বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের কাঠামোর উপর।
সত্যজিতের এআই এবং রোবটিক্স-সম্পর্কিত ভাবনা মূর্ত হয়েছে প্রধানত তাঁর চারটি গল্পে— যার তিনটি শঙ্কু-কাহিনি, আর একটি স্বতন্ত্র কল্পবিজ্ঞানের গল্প। শতকের আধখানা পেরিয়ে বোঝা যায়, এগুলো শুধুমাত্র আজকের বা আরও ভবিষ্যতের রূপমঞ্জরি নয়— আজকের দিনের মানুষ, তার মানবিক টানাপড়েন এবং এআই-এর সঙ্গে সহাবস্থান, এমনকি সংঘাতেরও চিত্রকল্প।
গল্প চারটির মধ্যে সবার শেষে লেখা ‘কম্পু’। ১৯৭৮ সালে। কম্পুকে মূলত ‘বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপিডিয়া’ করে গড়ে তোলা হয়, যে উত্তর দিতে পারে পঞ্চাশ কোটি প্রশ্নের। অঙ্ক কষতে না পারলেও সে খেলতে পারে ব্রিজ বা দাবা, বিচার করতে পারে গানের সুর, রাগরাগিণীর কিংবা পেন্টিংয়ের, দিতে পারে ওষুধ-পথ্য। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সহজেই বোঝা যায়, কিছু অপূর্ণতা সত্ত্বেও কম্পু কোনও দক্ষ জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক পূর্বসূরি। কিংবা তার চাইতেও বেশি কিছু। কম্পু আদপে এক বহুমাত্রিক জেনারেটিভ এআই, যে একযোগে অনেকটা চ্যাটজিপিটি, জেমিনি কিংবা গ্রক-এর মতো প্রশ্নের উত্তর দিতে তৈরি; ছবি আঁকতে না পারলেও ক্যানভা, ম্যাজিক মিডিয়া বা ডেল-ই-এর মতো ছবি বুঝতে ওস্তাদ; আলফাজ়িরো, স্টকফিস অথবা লীলা চেস জ়িরো-র মতো দাবা খেলার মাস্টার; আরজিন কিংবা নুক-এর মতো ব্রিজ খেলার এআই; এবং আরও অনেক কিছু। এমন বহুমাত্রিক এআই মডেল হয়তো বাস্তব হয়ে উঠবে অদূর ভবিষ্যতেই।
গোড়ায় কম্পুর ক্ষমতার পরিধির বাইরে ছিল ‘চিন্তাশক্তি, অনুভবশক্তি আর অলৌকিক শক্তি’। ভবিষ্যদ্বাণীও ছিল তার আওতার বাইরে। সুতরাং, সাধারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতাগুলি গল্পের শুরু থেকেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গল্পের চৌহদ্দিতেই কিন্তু কম্পু কখন যেন জেনারেটিভ ‘এআই’ বা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ থেকে একটি ‘আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘এজিআই’-তে রূপান্তরিত হয়। অর্জন করে ফেলে চিন্তাশক্তি ও বিচারশক্তি। এমনকি নিজের বিবেচনা অনুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়াও শুরু করে কম্পু। এক দিন বলে বসে সে স্বপ্নের রহস্য জানে, স্মৃতির রহস্য জানে, মাধ্যাকর্ষণ জানে, জানে সৃষ্টির গোড়ার কথা। কম্পুর এই বিবর্তন আমাদের বিস্মিত করে, আমাদের ভয় পাওয়ায়।
ভয়— কারণ এ সবের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর ভবিষ্যতের কল্পনা রয়েছে, যেখানে এআই স্বয়ংচালিত হয়ে পড়ছে। সে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করছে নিজেকে। মানব-সমাজের অস্তিত্বই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে অতল খাদের সামনে। এই ভয়ই তো তাড়িয়ে ফিরছে আজকের এআই-এর গডফাদার নোবেল-বিজয়ী ফিওফ্রে হিনটন কিংবা দিকপাল লেখক ইয়ুভাল নোয়া হারারি-কে। এবং আরও
অনেক মহারথীকে।
আজ আমরা যে সমস্ত এআই যন্ত্রকে দেখি আমাদের পরিমণ্ডলে, তা মূলত সঙ্কীর্ণ এআই, যা নির্দিষ্ট কোনও না কোনও কাজের জন্য প্রশিক্ষিত। ‘এজিআই’ এখনও পর্যন্ত কাল্পনিক, যার বুদ্ধিমত্তা একেবারে মানুষের মতো, যা বিভিন্ন কাজ এবং পরিস্থিতিকে বুঝতে, শিখতে, এবং পরিস্থিতি অনুসারে নিজের জ্ঞান প্রয়োগে সক্ষম। সক্ষম জ্ঞানের সাধারণীকরণে এবং নতুন প্রেক্ষাপটে
খাপ খাওয়াতে।
‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’তে শঙ্কু লিখেছেন, “আমার বৈজ্ঞানিক বিদ্যেবুদ্ধি দিয়ে আমি যে জিনিস তৈরি করি, সেগুলো অনেক সময়েই আমার হিসেবের বেশি কাজ করে। তাতে এক এক সময় মনে হয়েছে যে হয়তো বা কোনও অদৃশ্য শক্তি আমার অজ্ঞাতে আমার উপর খোদকারি করছে।” আচ্ছা, এটাই কি এআই-এর এজিআই-তে পরিণত হওয়া?
এআই এবং রোবট নিয়ে সত্যজিতের প্রথম গল্প সম্ভবত এই ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’, যা প্রকাশিত হয় ১৯৬১তে। যে বছর ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশে গেলেন। এটা প্রোফেসর শঙ্কুর প্রথম গল্পও বটে। নীল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদে যাওয়া কিংবা আলেক্সি লিওনভের মহাকাশে হাঁটার কয়েক বছর আগে লেখা এই গল্পটা। মহাকাশ-যাত্রার প্রেক্ষাপটে এই গল্পে লেখক কিন্তু আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন রোবট বিধুশেখরের সঙ্গে, যে প্রোফেসর শঙ্কুরই সৃষ্টি। বিধুশেখর প্রথমে ছিল বোকা, কথা বলার ক্ষমতা ছিল সীমিত। তবে তার মধ্যে মাঝেমধ্যে দেখা যেত অতিপ্রাকৃত বুদ্ধির ঝলক। এমনকি শঙ্কুকে তাঁর মঙ্গল অভিযানের রকেটের উপাদান সম্পর্কিত পরামর্শও দেয় সে। এও সম্ভবত ‘এআই’-এর ‘এজিআই’-তে রূপান্তরের এক চিত্রকল্প। অবশ্য বাংলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বাচ্চাদের অন্যান্য জমাটি গল্প লেখা হয়েছে সে সময়। লীলা মজুমদারের ‘বাতাস বাড়ি’তে ঊনপঞ্চাশ নামের এআই যেমন এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
যাই হোক, সত্যজিতের বিধুশেখর কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্পর্কিত আজকের মানুষের বেশ কিছু সমস্যার প্রতিবিম্ব। আজ তো মাঝেমধ্যেই বিতর্ক ওঠে এআই-এর ভুল কিংবা বিতর্কিত আচরণ নিয়ে। ওদিকে ছ’দশক আগেই বিধুশেখরের ‘মাথা’টা যে বার বার গন্ডগোল করেছে, তার উল্লেখ রয়েছে শঙ্কুর ডায়রিতে। মঙ্গল যাত্রাপথে বিধুশেখর হঠাৎ এক লাফে যন্ত্রপাতির বোর্ডের কাছে উঠে গিয়ে হ্যান্ডেল টানলে রকেটটা উল্টো দিকে যাওয়া শুরু করে। মঙ্গলগ্রহে পৌঁছে হঠাৎই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বিধুশেখর— সে আক্রমণ করতে যায় মঙ্গলবাসীদের। আবার শঙ্কুর রকেটটি যখন টাফা গ্রহের কাছাকাছি, তখন বিধুশেখর বলে সেখানকার বাসিন্দারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং উন্নত প্রাণী। পরে দেখা গেল, সেই দাবিটি ভুল।
১৯৭১-এর গল্প ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’তে রোবু ছিল অঙ্ক করতে ওস্তাদ। কিন্তু শঙ্কু বলছেন যে, “ব্রেন যা কাজ করে, তার অনেকগুলোই রোবু পারে না। যেমন সুখ-দুঃখ অনুভব করা, বা কারুর ওপর রাগ করা বা হিংসে করা— এ সব রোবু জানেই না।” অর্থাৎ ‘রোবু’ একটা সাধারণ এআই রোবট। ওদিকে বোর্গেল্ট-রূপী দুষ্টু রোবটটি নিজের নাম বলতে বললে কিন্তু কিছু বলে না চুপ করে থাকে রোবু। কী করে সে বুঝল, সামনে যে রয়েছে সে আসল বোর্গেল্ট নয়? ‘যন্ত্রই যন্ত্রকে চেনে ভাল!’ এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন সত্যজিৎ। সাত বছর পরের গল্পে ‘কম্পু’ কিন্তু বুঝতে পারে যে উইঙ্গফিল্ড অসৎ। যন্ত্র সেখানে মানুষকেও ‘চিনতে’ পারে। এটা কি এআই-এর বিবর্তন?
মানুষ আর এআই-এর সম্পর্ক এক অনন্য গভীরতায় পৌঁছয় ১৯৭৬-এর গল্প ‘অনুকূল’-এ। ‘টার্মিনেটর’, ‘ট্রান্সফরমার্স’, ‘আই, রোবট’ কিংবা ‘এক্স মেশিনা’-র মতো সৃজনশীল চিন্তা-উদ্দীপক চলচিত্রের বহু আগে ভবিষ্যতের আভাসে ঋদ্ধ এই গল্পটি আমাদের দাঁড় করায় নৈতিকতা এবং মানবতার সারমর্ম সম্পর্কিত প্রশ্নের মুখে।
‘অনুকূল’ শব্দটির অর্থ সহায়ক। এ গল্পে নিকুঞ্জ বাঁড়ুজ্জে গৃহকর্মের জন্য একটি অ্যান্ড্রয়েড ভাড়া নেন রোবট সাপ্লাই এজেন্সির দোকান থেকে। তারই নাম অনুকূল। নিখুঁত, দক্ষ এবং মানবিক মূল্যবোধ ও নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রোবটটি দেখতে মানুষের মতো। আচরণে, কাজে আর চিন্তাতেও সে মানুষের মতো। বিক্রয়কর্মী নিকুঞ্জবাবুকে সতর্ক করেন অনুকূলকে ‘তুই’ বলে না ডাকতে এবং আঘাত না করতে। নিকুঞ্জবাবুর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে অনুকূলের। নিকুঞ্জবাবুর ব্যবসায় মন্দা এলে তার পক্ষে অনুকূলের জন্য চড়া ভাড়া জোগানো কঠিন হয়ে পড়ে, যা তিনি জানান অনুকূলকে। অনুকূলও ভাবতে থাকে কী ভাবে নিকুঞ্জবাবুর অবস্থার উন্নতি সম্ভব। ইতিমধ্যে নিকুঞ্জবাবুর সেজোকাকা নিবারণবাবু আসেন তার বাড়িতে। অনুকূল নিবারণের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথার ভুল ধরলে নিবারণ রেগে গিয়ে চড় মারেন অনুকূলকে। প্রতিশোধ নিতে অনুকূল একটা হাইভোল্টেজ শক দেয় নিবারণের নাভিতে। মৃত্যু হয় নিবারণের। নিবারণের করে যাওয়া উইলে ভাইপো নিকুঞ্জ পান সাড়ে এগারো লক্ষ টাকা। গল্পটা মোটামুটি এই।
গল্পটি মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহাবস্থান, বোঝাপড়া, উত্তেজনা, এবং সম্পর্ককে ভেঙেচুরে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করে। মানুষ এবং যন্ত্রের মাঝখানের অযান্ত্রিক সীমারেখার আবছায়া, চেতনার প্রকৃতি এবং প্রযুক্তি যখন সেই সীমান্তকে ঝাপসা করে সে সময়ে উদ্ভূত নৈতিক দ্বিধা সম্পর্কিত চিন্তা-উদ্দীপক প্রশ্ন তোলে, আমরা গভীর দ্বন্দ্ব আর অস্বস্তির মুখোমুখি হতে বাধ্য হই। এআই চ্যাটবট এবং তাদের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক অ্যালগরিদম সমাজপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার অনেক আগেই, সেই প্রাক্-আন্তর্জাল যুগে সত্যজিৎ যেন বুঝতে পারেন আমাদের আজকের জিজ্ঞাসাসমূহ। গল্পগুলি তাই পরিণত হয় ভয়াবহ প্রাসঙ্গিকতায়। সত্যজিতের ‘অনুকুল’ অবশ্য কোনও সহজ, নির্দিষ্ট উত্তর দেয় না, বরং তা পাঠককে গভীরতর ভাবনা-চিন্তায় প্ররোচিত করে।
পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন, অনুকূল কর্তৃক নিবারণের হত্যার মধ্যে তার প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধের সঙ্গেও জুড়ে থাকে নিকুঞ্জর আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তির পথ। কিন্তু স্বয়ংচালিত এআই রোবট যদি কোনও মানুষকে হত্যা করে, সেটা কি ডিস্টোপিয়ান চিত্রণ নয়? এআই রোবট কী ভাবেই বা জানল নিবারণের উইলের কথা, সেটাও এক প্রশ্ন বটে। আবার নিকুঞ্জ-অনুকূলের সহযোগিতা ও সহাবস্থান কি উন্মোচিত করে মানুষ-এআই সম্পর্কের এক নতুন দিক? যে সম্পর্কের আবেশে এআই রোবট স্ব-ইচ্ছায় হত্যা পর্যন্ত করতে পারে আর এক জন মানুষকে? এক অজানা ভবিষ্যৎ আমাদের শিহরিত করে।
সত্যজিতের গল্পগুলি এআই যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, মানবিক এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহাবস্থান নিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক চর্চাকে উস্কে দেয়। যেমন, টাফা গ্রহের অধিবাসীদের সম্পর্কে একগাদা মিথ্যে কথা বলে বিধুশেখরই নিজেকে শঙ্কুর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। আমরাও কিন্তু মানবিক এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্পর্কের অজানা জটিল টানাপড়েনের বহুরূপ দর্শন করতে থাকি।
সেই ১৯৪২ সালেই তাঁর ‘রানঅ্যারাউন্ড’ গল্পে আইজ়াক অ্যাসিমভ বর্ণনা করলেন রোবটিক্সের তিনটি সূত্র। সেখানে একমাত্র নিজেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্য ছাড়া কোনও রোবট কোনও মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। তাঁর গল্পে সত্যজিৎ এই সূত্রগুলিকে মাথায় রেখেছেন নিশ্চয়ই। তবু ‘রোবু’ গল্পে শঙ্কুর তৈরি রোবটটি কৃতজ্ঞতার অনুভূতি থেকে তার স্রষ্টার জীবন বাঁচাতে চাইলেও বোর্গেল্টের বানানো এআই রোবটটি ক্ষতি করে তার স্রষ্টার। সে বোর্গেল্টকে বন্দি করলেও হত্যা করেনি তাকে। বুদ্ধিমান রোবটটি বোঝে, যদি সে বিগড়ে যায়, তা হলে কেবল এই মানুষটিরই ক্ষমতা রয়েছে তাকে ঠিক করার। এআই এবং রোবট নিয়ে আজকের মানুষের টানাপড়েন তাই প্রশ্রয় পায় সত্যজিতের গল্পে।
আবার ‘রোবু’র গল্পে বিজ্ঞানী পমার শঙ্কুর রোবুর মাথার ভিতর তাঁরই আবিষ্কৃত একটা যন্ত্র ঢুকিয়ে দিলে শঙ্কুর সঙ্গে নাকি ওর মনের একটা টেলিপ্যাথিক যোগ হয়ে যায়। শঙ্কুর বিপদ বুঝে তাই সে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। আজ ধনকুবের ইলন মাস্কের কোম্পানি ‘নিউরালিঙ্ক’ যখন মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে এআই যন্ত্রের সংযোগ ঘটিয়ে যন্ত্র-মানুষ বা ‘সাইবর্গ’ নির্মাণে তৎপর, সেই পটভূমিতে রোবুর সঙ্গে শঙ্কুর মনের এই সংযোগ স্থাপন বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। কিংবা এও কি মানুষ আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহযোগের, কিংবা সহযোগিতার, এক ভিন্ন ছবি? রোবুর ‘মন’টা যে কী বস্তু, সেটাও আমাদের ভাবিয়ে তোলে বইকি।
মনের চর্চা অবশ্যই এক সঘন রূপ নেয় ‘কম্পু’তে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় গল্পের একেবারে শেষে কম্পুর ঘোষণা যে, সে মৃত্যুর পরের অবস্থা জানে। সেই ‘আননোন আননোন’কে নিয়ে রহস্যটুকুকে গল্পের অতিনাটকীয়তা হিসেবে ধরে নিলেও কম্পুরও বয়স বাড়ে, বয়সের ছাপ পড়ে তার চেহারায়। সহজ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়ায় কম্পু এক সময় বলে বসে, “যা জানো তা জানতে চাওয়াটা মূর্খের কাজ।” না, চ্যাটজিপিটি কিংবা জেমিনি এখনও এমন কথা বলে বসেনি আমাদের। আমরা কিন্তু ভয়ে ভয়ে থাকি— কোনও এক অবাক মুহূর্তে যদি জেনারেটিভ এআই-তে হঠাৎই এমন ‘প্রাণ’ প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়— কোনও প্রশ্নের উত্তরে সে যদি বলে বসে, আমাদের মতো বোকাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে ‘মানুষ’ করার দায় তার নেই! কী হবে সে দিন? আপাতত বেশ ভয়ে ভয়েই হাতড়ে বেড়াতে হচ্ছে উত্তরটা।