আলোকদূষণ’ শব্দটি আমি প্রথম শুনি পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিতে বেড়াতে গিয়ে। বলেছিলেন ডেথ ভ্যালিতে অবস্থিত ‘দ্য ইন’ নামের রিসর্টের তত্ত্বাবধায়ক মার্টিনা। তিনি আমাকে রিসর্টের খোলা ছাদে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন যে, রাতে সেখানে বসে তাঁদের অতিথিরা তারা দেখেন। কোনও টেলিস্কোপ প্রয়োজন হয় না। বলেছিলেন, “দেখতে পাচ্ছেন তো কেমন খোলামেলা আকাশ এখানে, আর রাতে কোনও আলোকদূষণও নেই।”
‘আলোকদূষণ’ শব্দটি শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, শব্দদূষণ জানি, পরিবেশ দূষণ জানি, কিন্তু আলোকদূষণ বলে কোনও কথা তো শুনিনি আগে!
তাই প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলাম, “আলোকদূষণ বলতে কী বোঝাতে চান আপনি?”
ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, “আপনি নিজে তো ভারতবর্ষের একটা মেট্রো সিটিতে থাকেন। সে শহরটা কি আলোকদূষণে দূষিত নয়? আপনি কি আপনার বাড়ির ছাদে বসে আকাশের তারা দেখতে পান? শহরের আলোতেই কি আলোকিত নয় সে আকাশ? অথচ এখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার বলে কোটি কোটি তারা দেখতে পাই আমরা প্রতি রাতে।”
ঠিক তখনই না বুঝলেও, সেই রাতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম নিশ্ছিদ্র অন্ধকার কাকে বলে। কারণ, চোদ্দো হাজার বর্গ কিলোমিটারের ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে দুটো রিসর্ট, একটা পেট্রল পাম্প আর একটা ইনফরমেশন সেন্টার ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। আলোর উৎস যেখানে নেই, সেখানে উৎসারিত হওয়ার প্রশ্নও নেই। তখনই বুঝেছিলাম, অন্ধকার আকাশেরও একটা আশ্চর্য সৌন্দর্য আছে। সত্যিই শহরের অজস্র আলো সে অন্ধকারকে ছিঁড়েখুঁড়ে দেয় বরাবর।
সময়টা ছিল ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। দিনটা ছিল মাঘী পূর্ণিমা। সূর্যাস্তের পর পরই সোনার থালার মতো একটা চাঁদ উঠল আকাশে। রাত যত বাড়তে লাগল, অন্ধকার যত গাঢ়তর হতে লাগল, চাঁদের ঔজ্জ্বল্যও বাড়তে লাগল পাল্লা দিয়ে। তার সাঙ্গোপাঙ্গ তারারাও একে একে জ্বলে উঠতে লাগল পুবে-পশ্চিমে, উত্তরে-দক্ষিণে। দূষণমুক্ত আবলুস-কালো আকাশ জুড়ে ঝলমল করতে লাগল অসংখ্য তারা। মনে হল যেন কেউ ঝুলি ভরে হিরে নিয়ে যাচ্ছিল কোথাও, মাঝপথে ঝুলি ছিঁড়ে সমস্ত হিরের কুচি ছড়িয়ে গেছে আকাশময়। সেই আকাশভরা চন্দ্র-তারার মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী মানুষ বলে মনে হল আমার। কিছু ক্ষণ সেই অলৌকিক আলো সারা শরীরে মেখে হেঁটে বেড়ালাম নির্জন প্রান্তরটায়। কেননা এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য মানুষের জীবনে বার বার আসে না। এমন মৃদু আলো-মাখা নিকষ অন্ধকারে চোখে আর মনে যে আরামের প্রলেপ পড়ে, তার রেশ থেকে যায় বহু দিন।
এর দিন তিনেক পরই আমরা গেলাম দক্ষিণ-পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ার জশুয়া ট্রি ন্যাশনাল পার্কে। এই পার্কটির অবস্থান লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে দু’শো কিলোমিটার দূরে এবং পাম স্প্রিং-এর কাছাকাছি। সে-ও এক অদ্ভুত পার্বত্য মরুভূমি! সেখানকার মরুভূমিতে বালি নয়, আছে শুধু রুক্ষ পাহাড়। তবে সবুজের ছোঁয়া আছে, আর আছে দু’ধরনের বাস্তুতন্ত্র। তার কারণ, এই জাতীয় উদ্যানটি গঠিত হয়েছে দু’টি মরুভূমির অংশ নিয়ে— একটির নাম মোহাভে, অন্যটির নাম কলোরাডো। তাই এই উদ্যানে দু’ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। এক-এক ধরনের জীবগোষ্ঠী এক-একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। যেমন, চোলা ক্যাকটাস ও জশুয়া ট্রি।
এ বারে আসি আসল প্রসঙ্গে। তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট ন্যাশনাল পার্কটিতে পৌঁছে জানা গেল, এই উদ্যানে কোনও আলোর উৎস নেই, পানীয় জল নেই, খাবারের দোকান নেই, এমনকি সেলফোনের টাওয়ারও নেই। তাই যাঁরা হাইকিং বা ক্যাম্পিং করতে আসেন তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে আসেন। হ্যাঁ, তবুও আসেন মানুষ এই নির্জন প্রান্তরে। কারণ সে দেশের মানুষ অত্যন্ত অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে কিংবা বিনোদন-গাড়ি (রিক্রিয়েশন ভিকেল) সঙ্গে নিয়ে এসে তাঁরা রাত্রিবাস করেন। অন্ধকার রাতে পাহাড়ের মাথায় চড়ে আকাশ দেখেন, তারা দেখেন। এই উদ্যানে কোনও আলোকদূষণ নেই বলে, এখানকার আকাশ নিকষ কালো। তাই ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ ছুটিছাটা পেলেই ছুটে আসেন এখানে। ২০১৮ সাল থেকে এই উদ্যানটির নতুন নামকরণ হয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই পার্ক’।
এপ্রিল মাসের অমাবস্যা-সহ সাতটি দিনকে বলা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই উইক’। এই সপ্তাহটিকেই সারা পৃথিবীর মানুষ উদ্যাপন করেন যথাসম্ভব কম আলো জ্বালিয়ে। এই উদ্যাপন শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যের জেনিফার বারলো নামের এক হাই স্কুল-ছাত্রীর উদ্যোগেই এটি সম্ভব হয়েছিল। জেনিফার একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে সারা পৃথিবীতে তার বার্তাটি ছড়িয়ে দিয়েছিল। যেটি বর্তমানে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই অ্যাসোসিয়েশন’, ‘আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’, ‘আমেরিকান লিগ’ এবং ‘স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ’-এর মতো বিশ্ববিশ্রুত সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত।
কিন্তু কেন এই সচেতনতা? প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে মেশা ছাড়াও আছে রাতের আকাশের অপরূপ রূপ ও অপার মহাজাগতিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা, বন্যপ্রাণীদের রাত্রিকালীন জীবনযাত্রা ও বাস্তুতন্ত্র ব্যাহত না করা এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অপব্যয় রোধ।
আমাদের দেশও কিন্তু পিছিয়ে নেই এ ব্যাপারে। মহারাষ্ট্রের পেঞ্চ টাইগার রিজ়ার্ভ পার্ককে ভারতের প্রথম ‘ডার্ক স্কাই পার্ক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া লাদাখের হানলেতেও একটি ‘ডার্ক স্কাই রিজ়ার্ভ’ আছে, যেখানে রয়েছে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স-এর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজ়ারভেটরি। সেখানকার দূষণমুক্ত রাতের আকাশে ‘আকাশগঙ্গা’ প্রত্যক্ষ করা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু একই সঙ্গে পেঞ্চ-এর নাইট সাফারি কিন্তু বন্যপ্রাণীদের রাত্রিকালীন জীবনযাত্রা ব্যাহত করে।