ইসলামাবাদ, ১০ মে: কুখ্যাত জঙ্গি ওসামা বিন লাদেন, পরমাণু অস্ত্র এবং ইসলামি রূপকথার চরিত্র ‘জিন’— তিন বিষয়কে এক সুতোয় বুনলে উঠে আসে পাকিস্তানি সেনার জনসংযোগ দফতর (আইএসপিআর)-এর ডিরেক্টর জেনারেল আহমেদ শরিফ চোধুরির নাম। তাঁর বাবা সুলতান বশিরুদ্দিন মাহমুদের দৌলতেই তাঁর এই পরিচয়। সাম্প্রতিক ভারত ও পাকিস্তান সংঘর্ষে পাক সংবাদমাধ্যমে বার বার বিবৃতি দিচ্ছেন জেনারেল চৌধুরি। সেই প্রেক্ষিতে সংবাদমাধ্যমের আতশকাচের নীচে তিনি ও তাঁর পরিবার। উঠে এসেছে তাঁর বাবার পরিচয়।
পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু প্রযুক্তিবিদের সম্মান, ইসলামিক স্টাডিজ়-এর গবেষণা থেকে শুরু করে আল কায়দা-সহ একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ—আহমেদ শরিফের বাবা সুলতান বশিরুদ্দিন মাহমুদ বার বার উঠে এসেছেন আলোচনায়। জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগ থাকার অভিযোগে তাঁর নাম রাষ্ট্রপুঞ্জের নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছে। ২০০১ সালে অগস্ট মাসে কুখ্যাত জঙ্গি ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তিনি দেখা করেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের এমনও অভিযোগ। তার ঠিক পরেই ঘটে ৯/১১-এর সেই ভয়ানক ঘটনা।
১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে (পিএইসি) যোগ দেন মাহমুদ। তাঁর জন্ম পাকিস্তানে, শিক্ষা ব্রিটেনে। পাকিস্তানের পারমাণবিক পরিকাঠামো ও পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার তৈরিতে তাঁর নাম অনস্বীকার্য। প্লুটোনিয়াম-নির্ভর অস্ত্র তৈরিতে যে ধরনের রিয়্যাক্টর প্রয়োজন, তা তৈরিতে তাঁর প্রভূত পরিকল্পনা ও ভূমিকা রয়েছে।
এ দিকে, সাংবাদিক ডগলাস ফ্রান্জ় ও ক্যাথারিন কলিনস তাঁদের ‘দ্য ম্যান ফ্রম পাকিস্তান’ বইয়ে দাবি করেছেন, পাক পরমাণু অস্ত্র ভান্ডারকে সারা পৃথিবীর মুসলিম সম্প্রদায়ের ভান্ডার মনে করেন জেনারেল আহমেদের বাবা। তাঁর দাবি, পশ্চিমের শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে ইসলামিক দেশগুলির একে অপরের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন।
পাকিস্তানের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অসামরিক সম্মান, ‘সিতারা-ই-ইমতাজ়’ পেয়েছেন মাহমুদ। প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফ সেই পুরস্কার দিয়েছিলেন তাঁকে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, পরে শরিফের তীব্র সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন মাহমুদ। প্রকাশ্য সংবাদমাধ্যমে নওয়াজ়ের বিরুদ্ধে একাধিক বার তোপ
দেগেছেন তিনি।
তবে পিএইসি থেকে ১৯৯৯ সালে অবসর নেওয়ার পরেই মাহমুদের কার্যকলাপে টনক নড়ে পশ্চিমের একাধিক দেশের গুপ্তচর সংস্থার। বিশেষ করে জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও তাদের নীতি ও মতবাদে তাঁর আগ্রহ— এই বিষয়টিই তাঁকে বার বার বিতর্কের আওতায় নিয়ে এসেছে। ১৯৯৯ সাল থেকে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইও নজর রাখতে শুরু করে তাঁর উপর।
নতুন শতাব্দীর প্রথম দশক, অর্থাৎ ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে উম্মা তামির-ই-নাউ (ইউটিএন) বলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরি করেন মাহমুদ। তবে সেই সংগঠনের প্রধান তিনি একা ছিলেন না, তাঁর সঙ্গে ছিলেন ইসলামিক স্টাডিজ়ের স্কলার ডক্টর ইসরার আহমেদ। তালিবান অধিকৃত আফগানিস্তানে সক্রিয় ছিল ইউটিএন। সংগঠনটির দাবি ছিল, বিধ্বস্ত কান্দাহারে স্কুল-সহ নানা পরিকাঠানো তৈরি করছে তারা। সাহায্য করছে আফগানদের। তদন্ত চালিয়ে আমেরিকা ও পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা পরে জানতে পারে, জঙ্গিদের নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে এবং তাদের যথাযথ সহায়তা করতেই তৈরি করা হয়েছিল ইউটিএন। স্কুল তৈরি করা বা আফগানদের সাহায্যের বিষয়টি মুখোশ ছাড়া আর কিছুই নয়।
রাষ্ট্রপুঞ্জের আশঙ্কা, ৯/১১-এর কুখ্যাত হামলায় মাহমুদের হাত থাকতে পারে। যদিও তার কোনও দৃঢ় প্রমাণ নেই। রাষ্ট্রপুঞ্জের দাবি, ২০০১ সালের অগস্ট মাসে নিজের সহকর্মী চৌধুরি আবদুল মজিদকে সঙ্গে নিয়ে ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করেন মাহমুদ। কান্দাহারে হওয়া এই বৈঠকে পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত আলোচনা ও নকশা হাতবদল হয় বলে দাবি। তার পরেই পাকিস্তানের প্রশাসন গ্রেফতার করে তাঁকে। পালা করে জেরা শুরু করে আইএসআই। যদিও পরে প্রমাণাভাবে ছাড়া পান তিনি। আইএসআই জানিয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্র একা হাতে তৈরি করার মতো প্রশিক্ষণ মাহমুদের নেই।
মাহমুদের প্রতি দীর্ঘদিন ধরেই নজর রয়েছে পশ্চিমের গুপ্তচর সংস্থাগুলির। তিনি এখন কোথায় থাকেন তা নিয়েও রয়েছে রহস্য। কোনও কোনও সংবাদ সংস্থার দাবি, পাকিস্তানের ইসলামাবাদেই আত্মগোপন করে রয়েছেন মাহমুদ। ইসলাম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে একের পর এক বই লিখছেন তিনি। তবে তাঁর বেশির ভাগ লেখাতেই ইসলামি রূপকথার ‘জিন’-এর উল্লেখ থাকে প্রকট ভাবে। নিজের লেখায় তিনি বার বার দাবি করেছেন, পৃথিবীর শক্তি সঙ্কট মেটানোর জন্য জিন-এর সাহায্যই নিতে হবে মানুষকে।
মাহমুদের এই রঙিন জীবনের তুলনায় তাঁর ছেলে আহমদ শরিফ চৌধুরির জীবন অনেকটাই ছকে বাঁধা। সেনার প্রশিক্ষিত অফিসার হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু। একাধিক পদে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর মধ্যে রয়েছে ডিফেন্স সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অর্গানাইজ়েশনও (ডিইএসটিও)। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষার পরে ডিইএসটিও-র উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকা। তবে, ৯/১১-এর ঘটনার পরে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার জন্য তুলে নেওয়া হয় সেই নিষেধাজ্ঞা।
সংবাদ সংস্থা