রবীন্দ্রশিক্ষায় পরিশীলিত ভদ্রতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, যাকে বাদবাকি বঙ্গসমাজ ন্যাকাপনা মনে করেছিল। এই ভদ্রতাবোধ এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল যে, হস্টেলের সহায়িকা বা পাহারাদার কর্মী মহিলাদের কোনও ভাবেই অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতে শেখেনি ছাত্রছাত্রীরা। ছুটিতে, পরবে তাদের বাড়িতে অনায়াস যাতায়াত ছিল। সেখানেও তারা বাবুদের বাড়ির ছেলেপুলে বলে বিরাট কিছু সম্ভ্রম দেখাত না। আমাদের অনেকের ঝুলিতেই, বাঁধনা পরবের পোড়া মাছের আর ঈষৎ গেঁজে ওঠা তালমদিরা মাতালের গল্প আছে। আর ‘ক্ল্যানিশ’-এর উত্তরে বলা যায়, পৃথিবীর জাত-ধর্ম নির্বিশেষে যে যেখানে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাকে আঁকড়ে রেখেছেন, তিনিই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আজ সমগ্র দেশ জুড়ে ধর্মের আচারকে কেন্দ্র করে তার উদগ্র বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। আমরা যারা এখনও স্তম্ভিত, ব্যথিত হয়ে থাকি, অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ তাদের হাতিয়ার। আজ সদর্থেই ‘ক্ল্যানিশ’ রাবীন্দ্রিকদের অতি প্রয়োজন।
সহজ পথে চলব ভেবে পড়ব না
একঘেয়ে পরিশ্রমী রুটিনের বিরুদ্ধে বঙ্গ বুদ্ধিজীবীর এক ধরনের অবজ্ঞা আছে। রবীন্দ্রনাথ সেখানেও ব্যতিক্রমী। কবি-লেখকের হুল্লোড়ে শৃঙ্খল-বহির্ভূত জীবন যাপনে আমরা যারা শ্রদ্ধায় শিহরিত হই, তাঁদের জন্য একটি নিয়ম-সারণি দেখে নেওয়া যেতে পারে। সৈয়দ মুজতবা আলী, রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় ছাত্র লিখছেন, “সকালে চারটার সময় দু ঘণ্টা উপাসনা করতেন। তারপর ছটার সময় স্কুলের ছেলেদের মত লেখাপড়া করতেন। সাতটা, আটটা, নটা, তারপর দশ মিনিটের ফাঁকে জলখাবার। আবার কাজ— দশটা, এগারোটা, বারোটা। তারপর খেয়ে দেয়ে আধঘণ্টা বিশ্রাম। আবার কাজ— লেখাপড়া; একটা, দুটো, তিনটে, চারটা, পাঁচটা— কাজ, কাজ, কাজ। পাঁচটা থেকে সাতটা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন বা দিনুবাবুর আসরে বসে গান শুনতেন বা গল্প-স্বল্প করতেন। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে আবার লেখাপড়া, মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান— আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত। কী অমানুষিক কাজ করার ক্ষমতা! আর কি অপরিসীম জ্ঞানতৃষ্ণা!”
এই মেয়েটিকে নব্বইয়ের শুরুতে হাতখরচের জন্য এক বিদেশি মহিলার গবেষণার সঙ্গী হতে হয়েছিল। বাংলা না জানার কারণে অস্ট্রেলিয়ার মানুষ রুথের দোভাষী হতে হল। তিনি তাঁর দেশে রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রাচ্যের সন্ত কবি’ মনে করার যে প্রবণতা আছে, সেটিকে খণ্ডন করতে চান। বিদেশিনিকে সাহায্য করতে গিয়ে রবীন্দ্র ভবন থেকে আনা বহু পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল মেয়েটি।
কারও স্মৃতিকথায় সে পড়েছে, জওহরলাল নেহরু সপরিবার শান্তিনিকেতনে বেড়াতে আসছেন। একদা এখানকার ছাত্রী ইন্দিরা তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে সহজ ভাবে পৌষমেলায় ঘুরছেন।
ইন্দিরা যে ছাত্রীনিবাসে থেকেছেন, সেখানেই থাকে এই মেয়েটি। সমাবর্তনের সময় এক চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটল সেখানে। ইন্দিরা-পুত্র প্রধানমন্ত্রী রাজীব তখন তাঁদের উপাচার্য। হস্টেলের নানা সমস্যা নিয়ে বেদম হইচই প্রতিবাদ শুরু হলে স্বয়ং তিনি চলে এলেন হস্টেলের কমনরুমে। রাত ন’টা বেজে গেছে, ফলে মেয়েরা রাতপোশাকেই। কমনরুমে রাজীব এসেছেন, ফলে সবাই দুদ্দাড়িয়ে দৌড়। প্রথমেই রাজীবের দেহরক্ষীদের বাইরে বার করে দেয় মেয়েরা। হলের মধ্যে আদ্যিকালের কাঠের বেঞ্চে পদ্মপলাশলোচন রাজীব গান্ধী বসে আছেন, চার পাশে ভিড় করে শ্রীসদন বা ভবনের মেয়েরা। স্মিত হেসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মায়ের হস্টেলের আবাসিকদের কাছে শুনছেন, কোন একটি ব্লকে ভাল ভাবে জল আসে না, কল কাজ করে না, কোথায় চৌবাচ্চা নোংরা, কোন একটি ঘর বিশেষ গরম, পিছনের পাঁচিল ঠিক ততটা সুরক্ষিত নয়! ওই রাত্তিরে মেয়েদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে পরের দিন উনি আবার হস্টেলের ভিতরে এসে দেখে-টেখে গেছিলেন। যদিও তাতে অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটেনি! সুরসিক রবীন্দ্রনাথ এ সব দেখতে পেলে অবশ্যই মন্তব্য-সহ মুচকি হাসি উপহার দিতেন।
আর এক গল্প শোনা যেতে পারে। সদ্য শেষ হওয়া কলকাতা বইমেলায় এক গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত কবি-সাহিত্যিক জড়ো হয়েছেন। কলকাতার রাশিয়ান কনসুলেটের সদ্যনিযুক্ত কনসাল জেনারেল ম্যাক্সিম কজলভ উপস্থিত। শোনা গেছে তিনি নাকি বাংলা একটু-একটু বোঝেন, বলেনও। চলছে অনুষ্ঠান। চুপচাপ শুনছেন তিনি। কথা চলছে প্রকৃতি নিয়ে। বলতে বলা হল তাঁকে। বললেন, শিমুলতলার বাংলা বিভাগ থেকে হস্টেলের পাশ দিয়ে সোজা উত্তরায়ণের দিকে রাস্তা, ছাতিমতলার পিছন দিয়ে উদ্যান বিভাগের অত গাছ, গোয়ালপাড়া কোপাইয়ের দিকে বৃষ্টিতে ভেজা... এই সব আরও আরও জায়গা, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি তাঁর ছাত্রাবস্থায় রাশিয়ার বাইরে দেখা এক আশ্চর্য সৌন্দর্যময় পৃথিবী। প্রসঙ্গত বললেন, রবীন্দ্রনাথের জন্যেই আশির শেষ দশকে বাংলা বিভাগে পড়তে এসেছিলেন তিনি। কবিরা চুপচাপ। কেউ কেউ যে একটু আগে ভাবছিলেন ইউক্রেন নিয়ে কৌশলে কথা তুলবেন, শান্তিনিকেতনের অপরূপ বৃষ্টি আর কালবৈশাখীর ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।
প্রায় পনেরো-ষোলো বছর আগের কথা। ভারতীয় লেখকদের একটি ছোট্ট দল কানাডার বিভিন্ন শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা গল্পপাঠ আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। গুজরাতের কবি প্রবোধ পারিখ এর পরেই যাবেন স্পেন, বক্তৃতার বিষয় সেই রবীন্দ্রনাথ। এ বিষয়ে দলের সর্বকনিষ্ঠ কবি মেয়েটির শান্তিনিকেতনে পড়ে আসার কারণে গোপনে একটু গেরামভারি ভাব তো আছেই। অনুষ্ঠান চলছে ভ্যানকুভারের ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেমিনার হলের দোতলা-সমান কাচের দেয়ালের পর্দা কেউ একটা সরিয়ে দিল। আর অমনি মেয়েটির চোখ গেল পিছনে নানা বিদেশি বৃক্ষের অঙ্গনে এক আবক্ষ মূর্তির দিকে। রবীন্দ্রনাথ! এখানেও তিনি? তার পর আর কী, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে ছাত্রী জীবনের মতো ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে ঠিক তাঁর পাশে গিয়ে একটা ছবি তুলে ফেলা!
কোথা হা হন্ত, চির বসন্ত!
রবীন্দ্রসঙ্গীত ও কবিতা যে কত ভাবে মানুষকে নাড়া দেয়, তা শান্তিনিকেতনের ছেলেপুলেরা হাড়ে হাড়ে জানে! যেমন এক বসন্ত উৎসব, থুড়ি দোলের আগের রাতে উপাসনা মন্দিরের সামনে রাস্তায় এক টুরিস্ট দলের আবেগ উপস্থিত হয়। গান তাঁরা জানেন না, তাই বলে কি রবীন্দ্রনাথ চাপা পড়ে থাকবেন? প্লাবিত জ্যোৎস্নারাতে উদাত্তকণ্ঠে আবৃত্তি শুরু হয়, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর/ কেমনে পশিল প্রাণের পর...’ রবীন্দ্রনাথের আবাস উত্তরায়ণের একেবারে পিছনে মাটির বাড়ি শ্যামলীর ভিতরে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর একটি ছবি দেখে তাঁকে ইন্দিরা গান্ধী বলে অম্লানবদনে শনাক্ত করেছেন এক টুরিস্ট। রথীন্দ্রনাথের ছবি রবীন্দ্রনাথের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞরা এ সবে ভ্রু কুঞ্চিত করতে পারেন, কিন্তু আমজনতার তাতে বয়েই গেল! তাঁরা আছেন বলেই ঘরে ঘরে গীতা, বাইবেল, কোরানের পাশে রবীন্দ্র-রচনাবলি সম্ভ্রমে সজ্জিত থাকে। বিশ্বভারতীর প্রকাশনা সংস্থা থেকে এখনও রবীন্দ্রনাথের বইয়ের বিপুল বিক্রির খবর পাওয়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেয়ে থাকে গীতবিতানপ্রেমীদের স্নানঘরের শখের গান। তার মধ্যে অল্পবয়সি-সহ মধ্যবয়সিরাও বিরাজমান। আর কিছু না থাকলেও যে গান থেকে যাবে বলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয় ছিল, যে গানের সুরের ভরকেন্দ্র কথা, তা কত জনকে স্পর্শ করেছে, জানে সব্বাই। রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে বসা মেয়েটি আশ্রমের শিক্ষায় শিক্ষিত নবীন প্রজন্মের গায়িকাদের প্রশ্ন করেছিল, কেন এখনও তাঁরা রবীন্দ্রনাথের কাছেই ফিরতে চান। এ প্রশ্নের উত্তরে সাহানা বাজপেয়ী বলেন, “শান্তিনিকেতনে বড় হয়ে ওঠার যে ক’টি আশীর্বাদ পাওয়া যায়, তার মধ্যে অন্যতম এক আশীর্বাদ রবীন্দ্রনাথের গান। দৈনন্দিনতার জগাখিচুড়ি সমাজমাধ্যমের উত্তেজক অথচ ক্ষণস্থায়ী ডোপামিন বোঝাই অস্থিরতার বাইরে যে জগৎটি রয়ে গেছে, আমার মনে হয় তাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা ও গাওয়া ধরে রাখতে পারে। এই জন্যই, আমি বার বার রবীন্দ্রনাথের গানেই ফিরে যাই।”
অপরাজিতা চক্রবর্তীর মুখে শুনি, আজকের প্রজন্মকে যে পরিমাণে দৈনন্দিন প্রতিযোগিতায় মানসিক অবসাদের সম্মুখীন হতে হয়, রবীন্দ্রনাথ সেখান বিরাট আশ্রয়। আর এক নবীনা প্রকৃতি মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “তিনি চিরন্তন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দে উদ্যাপন করতে শিখিয়েছেন।”
ঢাকা শহরে রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পী সন্জীদা খাতুনকে তাঁর অনুরাগী ও শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমেই শেষ বিদায় জানিয়েছেন। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রীর প্রয়াণ-পরবর্তী নিয়ম পালনে উদার সাংস্কৃতিক চর্চার এই প্রকাশ এক সময় স্বতঃসিদ্ধই মনে হত। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কৃতি ও ধর্মকে পৃথক করে দেখার দৃষ্টিটি যেন হারিয়ে গেছে। সন্জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের গানকে তার যথার্থ ভাবনায় নিজের সমগ্র জীবনে বহন করলেন, শিক্ষার্থী-সহ বহু সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন। এ-ই তো চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা যারা রবীন্দ্রনাথকে দেখলাম না, তারা এমন একক মানুষের শান্ত ও স্পর্ধিত নীরব প্রতিবাদ দেখলাম।
ওই যে মেয়েটি নিজস্ব রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে বসে দেখতে পাচ্ছে, কাঁকর মেশানো শালবীথি দিয়ে হেঁটে আসছে যে ছায়াশরীর, তিনিই তো শিখিয়েছেন, এই সভ্যতার সঙ্কটে প্রতিরোধ ছাড়া পন্থা নেই, নিন্দা ছাড়া অস্ত্র নেই, স্বাধীন দেশ হলেও প্রকৃত স্বাধীনতা থাকে না কখনও কখনও।