চারটি ভিন্ন উপাখ্যানের সুন্দর নৃত্যভাবনা
সম্প্রতি রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠিত হল ডান্স ইন ড্রিম অ্যাকাডেমি, সাহানা ডান্স গ্রুপ, আলোর পাখি পারফর্মিং আর্টস ও কলাপী প্রযোজিত ‘চারবাক’ নৃত্যানুষ্ঠান। এ দিন সন্ধ্যার প্রথম নিবেদন ‘এক নায়ক’ নৃত্যালেখ্যতে শ্রীকৃষ্ণকে সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন রূপে দৃষ্টিলব্ধ করা হল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে অগ্রজ বলরাম ও বন্ধু সুদামার কাছে ক্লান্ত শ্রীকৃষ্ণ ফিরে আসেন এবং ফিরে যেতে চান বৃন্দাবনে শ্রীরাধার কাছে। কিন্তু সকলেই তাঁকে ফিরিয়ে দেন। পরিশেষে ব্যাধরূপী নিয়তির শরনিক্ষেপে শ্রীকৃষ্ণের জীবনাবসান হয়। শ্রীকৃষ্ণ অবতার। তাই যুগে যুগে তিনি মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে, মানুষের পাশে ফিরে এসেছেন। শুভেচ্ছা ভট্টাচার্য, অভিষেক নাথের পরিচালনায় এই নৃত্যনাট্যের সকল কলাকুশলী তাঁদের নিজ নিজ চরিত্রাভিনয়ে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
দ্বিতীয় নিবেদনে রুদ্রাভ নিয়োগীর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গ্রন্থ থেকে ‘মেঘমল্লার’ নৃত্যনাট্য। এই কাহিনিতে গল্পের নায়ক প্রদ্যুম্ন মহাকোটি বিহারের তরুণ বিদ্যার্থী। পূর্ণিমারাত্রে পাঠ ফেলে রেখে বেরিয়ে পড়ে প্রেয়সী সুনন্দাকে বাঁশি শোনানোর উদ্দেশ্যে। সে চেয়েছিল বীণ শিখতে। তাই ওস্তাদ খুঁজতে গিয়ে খলবুদ্ধি গুণাঢ্যের চক্রান্তের শিকার হয়। দেবী সরস্বতীকে কামতপ্ত তান্ত্রিক গুণাঢ্য পেতে চেয়েছিল ছলনার কৌশলে। গুণাঢ্যের চক্রান্তে বাঁশিতে মেঘমল্লার বাজিয়ে দেবীকে ধরায় নিয়ে আসে প্রদ্যুম্ন। পরিশেষে সে যখন জানতে পারল তার অজানিত পাপের কথা, তখন নদীর পবিত্র জলে দেবীর চরণ ধৌত করে তাকে মুগ্ধ করে ও নিজের পাপস্খালন করে।
এই নৃত্যনাট্যে প্রতীক হিসেবে সাহানা নৃত্যদল যে সকল সাজসরঞ্জাম ব্যবহার করেছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সমবেত নৃত্য ও নৃত্যশিল্পীদের পোশাক সুপরিকল্পিত। প্রথম দৃশ্যে প্রদ্যুম্ন এবং সুনন্দার আবির্ভাবের নৃত্যভাবনাটি সুন্দর। যে দৃশ্যে প্রদ্যুম্ন বাঁশিতে মেঘমল্লার বাজাচ্ছে আর পদ্মফুল হাতে দেবী সরস্বতীকে ধরায় আনয়ন করা হচ্ছে, ভাল লাগে। শেষে দেবীর আবির্ভাব এবং প্রদ্যুম্নের প্রস্তরমূর্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার দৃশ্যটি দর্শককে আকর্ষণ করে। তান্ত্রিক গুণাঢ্যের ভূমিকায় রুদ্রাভ নিয়োগী এবং প্রদ্যুম্নের ভূমিকায় রিপন দাসের বলিষ্ঠ, লীলায়িত নৃত্যভঙ্গিমা সকলকে মুগ্ধ করে। উত্তীয় জানার আলোর ব্যবহার যথাযথ।
তৃতীয় নিবেদনে আলোর পাখি সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস মঞ্চস্থ করল নৃত্যনাট্য ‘পৃথা খণ্ডিতা’। মহারাজ কুন্তীভোজের পালিতা কন্যা কুন্তী। তিনি কলহনের প্রেয়সী হওয়া সত্ত্বেও জাত্যাভিমানী পিতার কথায় মুনি দুর্বাসাকে তুষ্টি দেন। পৃথা অসমর্থ পাণ্ডুর ধর্ম রক্ষার্থে দেবতায় উপগত হন। এই নৃত্য উপস্থাপনা কুন্তী অথবা সেই সব নারীকে কেন্দ্র করে, সমাজ যাঁদের নানা বেড়িতে বেঁধেছে। কলহন, দুর্বাসা, কুন্তীভোজ, পাণ্ডু এবং আরও কয়েক জন মিলে পুরুষকারের যে অভ্রভেদী দেওয়াল তুলেছেন, পৃথা কোথাও সেই দেওয়ালকেই প্রশ্ন তুলেছেন, হেরে গিয়েও তিনি ‘খণ্ডিতা’ নন— সমাজের বহু খণ্ডকে নিজের অভিঘাতময় জীবনের আয়নায় বুঝতে চেয়েছেন বলেই তিনি ‘খণ্ডিতা’। আলোর পাখি সেই খণ্ডিতা পৃথার মধ্য দিয়ে মেয়েদের পূর্ণরূপের চিত্র দেখিয়েছে। কথাকারের ভূমিকায় রুদ্র মিশ্র সুন্দর অভিনয়ের মাধ্যমে কাহিনির বক্তব্যকে সুস্পষ্ট করেছেন। পৃথার ভূমিকায় যথাক্রমে সুস্মিতা নন্দী শেঠিয়া, ঝিনুক মুখোপাধ্যায় এবং শুভেচ্ছা ভট্টাচার্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই পৃথার চরিত্রের ভাবমূর্তিটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। দুর্বাসার চরিত্রে রুদ্রাভ নিয়োগী এবং কলহনের চরিত্রে স্বর্ণাভ মিশ্র যথাযথ। শেষ দৃশ্যে মাঝিদের নৃত্য এবং ঢেউয়ের তালে শিশুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মঞ্চে ত্রয়ী পৃথার দৃপ্ত ভঙ্গিমায় উপস্থিতির ভাবনাটি প্রশংসনীয়।
শেষ নিবেদন রবীন্দ্রনাথ প্রণীত ও কলাপী প্রযোজিত ‘শিশুতীর্থ’। এটি একটি নৃত্যকাব্য প্রযোজনা। যে সমাজে মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং হিংসা প্রকট, সেই সমাজের কথা, সেই মানুষদের কথা এবং তা থেকে কী ভাবে মানুষের উত্তরণ ঘটতে পারে, তারই কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ সেই কোন কালে! কিন্তু আজও সেই ভাবনা সমসাময়িক এবং সেই ভাবনায় ব্রতী হয়ে আজও মানুষের উত্তরণ ঘটতে পারে। হিংসা নয়, প্রেম দিয়ে জয় করতে হবে আপনার অধিকার... এ কথা কলাপী তাদের প্রযোজনার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দিতে চায়। সমগ্র ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটির চমৎকার নৃত্যরূপ দিয়েছেন সকল নৃত্যশিল্পী। ‘আমি চঞ্চল হে’, ‘জয় হোক জয় হোক’, ‘অন্তর মম বিকশিত করো’ (সঞ্চারী অংশ) এই তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার যথাযথ। শেষ দৃশ্যে তরুণদল যেখানে সকলকে ডাক দিয়েছে প্রেমের তীর্থে, শক্তির তীর্থে যাত্রা করার জন্য, সকলে যেখানে মৃত্যুর বিপদকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলেছে মৃত অধিনেতার আত্মা বহন করে— সেখানে প্রতীক হিসেবে সাদা বস্ত্রের ব্যবহার চমৎকার। নৃত্যাভিনয়, গান, আলোর ব্যবহার... সব কিছু মিলিয়ে একটি শান্ত সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। নিঃসন্দেহে ভিন্ন স্বাদের এই নৃত্যানুষ্ঠান ‘চারবাক’ একটি আনন্দদায়ক প্রযোজনা। আশা রাখব, নতুন ভাবনা নিয়ে এদের আরও নৃত্যানুষ্ঠান মঞ্চস্থ হবে।
বিপাশা মাইতি