পোসেরামরা কি বোড়ে, প্রশ্ন
বললেন, “এখন আমরা ভাল আছি। কিন্তু বেশি কিছু বলতে চাই না। জানি না, এখনও ওরা কোথায় লুকিয়ে আছে। পোসেরামের পরিণতি আমরা কেউই চাই না।” মাথা নেড়ে সায় দিলেন আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ-ছ’জন গ্রামবাসী। তাঁরা জানাচ্ছেন, পুলিশ ও বাহিনীর উপস্থিতিতে বহিরঙ্গে দৃশ্যপট পাল্টেছে। গ্রামের দেওয়াল থেকে মাও স্লোগান উধাও। বদলে গোলাপফুলের ছবি। স্কুলের পাঠ শেষ করে গ্রামের তরুণ-তরুণীরা এখন দান্তেওয়াড়ার কলেজে পড়ছেন। মাওবাদীদের হাতে নিহত পোসেরামের বড় ছেলে ধনীরাম এখন জেলা পুলিশের কনস্টেবল, ছোট ছেলে কেশব ডিআরজি-র কনস্টেবল। তবু দু’ভাই গ্রামের বাড়িতে থাকার ঝুঁকি নেন না।
ধনীরামের কথায়, “মাওবাদীরা এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা চায় না। গ্রামবাসীকে গ্রামে আটকে রেখে এবং তাঁদের সামনে রেখে আড়ালে থেকে সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধ করাই মাওবাদীদের উদ্দেশ্য।’’ আর কেশব বলছেন, ‘‘বাবার মতো অসংখ্য মানুষকে মাওবাদীরা নির্বিচারে পিটিয়ে, কুপিয়ে, ফাঁসি দিয়ে খুন করেছে। সেই সব মৃত্যুর বদলা
আমরা নিচ্ছি।’’
দান্তেওয়াড়ার ডিএসপি (বস্তার ফাইটার্স) গোবিন্দ দিওয়ান বলছিলেন, “বছর সাতেক আগেও এই সব এলাকায় ঢোকা যেত না। এখন গ্রামে গ্রামে বাহিনীর শিবির হয়েছে। উন্নয়ন কাজ চলছে জোর কদমে। এলাকার মানুষ আর মাওবাদীদের সঙ্গে নেই।’’
সত্যিই কি তাই? ছিন্দনার থেকে ইন্দ্রাবতী নদীর সেতু উজিয়ে কিলোমিটার পাঁচেক যাওয়ার পরই দু’পাশে জঙ্গল। ইতিউতি টিলা আর দূরে পাহাড়ের সারি। ছোট ছোট জনপদ। কিন্তু ছিন্দনারের তুলনায় বড্ড বেশি শুনশান। কাঁচা রাস্তার দু’পাশে জঙ্গলে অস্ত্র হাতে সিআরপি জওয়ানরা। দেখা গেল, চেরপাল পঞ্চায়েতের ছোটে কারকা গ্রামে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার পাকা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। সেই কারণেই এমন সতর্কতা। চারপাশে সিআরপি, ডিআরজি (ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড) এবং বস্তার ফাইটার্স-এর নজরদারি। বৃদ্ধা মাগলি মরকমের কথায়, “এখন এলাকায় প্রশাসন সর্বক্ষণ থাকছে। এই যে এত পুলিশ, সিআরপি দেখছেন। দিনরাত ওদের পাহারায় রাস্তা তৈরি হচ্ছে। ছিন্দনার পর্যন্ত সমস্যা নেই। তবে ছোটে কারকা হয়ে পাহাড়ের দিকের গ্রামগুলিতে এখনও ওদের প্রভাব রয়েছে।’’
২০০৫ সালে বিজেপির সরকার থাকাকালীন মাওবাদীদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগঠিত করে ‘সালওয়া জুড়ুম’ (শুদ্ধি-অভিযান) গড়ে তোলেন দন্তেওয়াড়ার কংগ্রেসি বিধায়ক মহেন্দ্র কর্মা। গোন্ডি ভাষায় যার অর্থ 'শুদ্ধি অভিযান', অথবা 'শান্তি অভিযান'। আদতে তা ছিল কার্যত রাষ্ট্র সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনী তথা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন। ওই সময়ে বিজেপির সরকার থাকলেও কর্মার এই উদ্যোগকে সমর্থন করেছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু মাওবাদীদের শত্রু হয়ে যান মহেন্দ্র। ২০১১ সালের ৫ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট ‘সালওয়া জুড়ুম’কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বন্ধের নির্দেশ দেয়। দু’বছর পর ২০১৩ সালের ২৫ মে কংগ্রেসের ‘পরিবর্তন যাত্রা’ শেষ করে ফেরার সময়
ঝিরম ঘাঁটি এলাকায় মাওবাদীদের অতর্কিত হামলায় মহেন্দ্র কর্মা এবং তৎকালীন ছত্তীসগঢ় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নন্দকুমার পটেল সহ ২৭ জন কংগ্রেস নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়। ঝিরম ঘাঁটিতে ২৭ জনের ছবি দিয়ে শহিদ স্মারক হয়েছে। স্থানীয় তোংপাল গ্রামের শালখান সিং বলছেন, ‘‘মহেন্দ্র ‘বস্তার টাইগার’ ছিলেন। উনি জীবিত থাকলে হয়তো অন্য রকম কিছু হত। মাওবাদী সন্ত্রাস, সালওয়া জুড়ুম পেরিয়ে এখন রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নয়ন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য, বাহিনী যাতে ওই সব এলাকায় পৌঁছতে পারে। যোগাযোগের উন্নতির ফলে যাতে মানুষের সুবিধা হয়। আখেরে কিন্তু মুখ্য উদ্দেশ্য মাওবাদীদের হত্যা করা।’’
তা হলে কি পোসেরামের মতো সরকারি প্রশাসনের লোকজনকে 'বোড়ে' হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে? একটি সেতুর আবেদনপত্র, আর তার বিনিময়ে মৃত্যু। তারপর এলাকায় বাহিনী দিয়ে রাস্তা তৈরি, বাহিনীর শিবির। এ ভাবে কি সমস্যা মিটিয়ে এলাকাকে মাওবাদী মুক্ত করা সম্ভব? প্রশ্ন উঠছে এবং উঠছে। (চলবে)