‘‘এ কার্ডে সমস্যা হবে না তো?’’ প্রশ্নকর্তা বাংলাদেশের রাজশাহীর বাসিন্দা। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গিতে চোরা পথে ঢুকে ঘোষপাড়া পঞ্চায়েত এলাকায় এক যুবককে আধার কার্ড তৈরি করতে দিয়েছেন ১২ হাজার টাকা। তাই বাজিয়ে নেওয়া।
কার্ড তৈরিতে পারদর্শী যুবকের জবাব, ‘‘চিন্তা নেই। আধার পোর্টালে ভিন্-রাজ্যের ‘ইউজ়ার আইডি’ ব্যবহার করে কাজ করি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, রেটিনা স্ক্যান, ফেস স্ক্যান করেই বানিয়ে দেয়া হয়েছে কার্ড। পুলিশ-প্রশাসন কার্ড স্ক্যান করলেও ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই।’’ একই রকম আশ্বাস শোনা যায় কোচবিহারের গীতালদহ, দিনহাটা, উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা বা মালদহের বামনগোলা, বৈষ্ণবনগর, কালিয়াচক, হরিশ্চন্দ্রপুরে ‘আড়কাঠি’দের (জাল কার্ড চক্রের দালাল) মুখে।
হরিশ্চন্দ্রপুর স্টেশন লাগোয়া এলাকায় গড়ে উঠেছে রেলের টিকিট কাটার চার-পাঁচটি কাউন্টার। পাশে চায়ের দোকানে বসা এক যুবকের দাবি, “আধার কার্ডে এ দিক-ও দিক করা কোনও ব্যাপার নয়। টাকা ফেললেই হয়ে যাবে।’’ কোথায়, কী ভাবে? জবাব আসে, ‘‘আম খান, গুটি গুনতে যাবেন না।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মুর্শিদাবাদের রানিনগর এবং সাগরপাড়া এলাকায় এমন একটি চক্র ধরা পড়েছে, যারা আধার কার্ড তৈরির জন্য যে সমস্ত সংস্থা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদেরই কারও না কারও কাছ থেকে ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড’, ‘লগ-ইন পাসওয়ার্ড’ সংগ্রহ করে জাল আধার কার্ড তৈরি করত। আবার কোচবিহারের দিনহাটার শুকারুরকুঠিতে ঘরে আধার কার্ড পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে একটি চক্র। যাদের ফোন করলে ঘরে বসে নতুন আধার কার্ড পাওয়া যায়। কোচবিহারের পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘ওই ব্যাপারে ধারাবাহিক নজরদারি চলছে।’’ পুলিশ সে চক্রের দু’জনকে ধরলেও এলাকায় গিয়ে শোনা গিয়েছে, ‘‘সার্ভিস চালু আছে। তবে এখন ঝুঁকি অনেক বেশি। আগে ২০ হাজার টাকা লাগত। এখন ৪০ হাজার লাগবে।’’ আধার কার্ডের ‘হোম ডেলিভারি’র এই চক্র কাজ করে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গিতেও।
আর জাল ভোটার কার্ড? সে কারবারে এক সময়ে জড়িত উত্তর ২৪ পরগনার এক যুবক জানান, কাজ হয় প্রধানত তিনটি উপায়ে। চোরাপথে এ দেশে ঢোকা অনেক বাংলাদেশির আত্মীয়েরা থাকেন এ রাজ্যের সীমানা লাগোয়া জেলায়। আত্মীয়দের বাড়িতে কিছুটা সময় থাকার সুবাদে স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রধানের শংসাপত্র জোগাড় করে চক্রের মাধ্যমে ভোটার তালিকায় নাম তুলে নিচ্ছেন তাঁরা। যেমন তুলেছিল গত ডিসেম্বরে কেরল থেকে জঙ্গি সন্দেহে ধৃত শাব রাডি ওরফে শাদ। হরিহরপাড়ায় তার কাকার বাড়ি, নওদায় পিসির। দু’জায়গায় ভোটার তালিকায় নাম ছিল শাদের।
আবার অনেকে এ রাজ্যের যুবক-যুবতীদের বিয়ে করে শ্বশুরকে ‘বাবা’, শাশুড়িকে ‘মা’ সাজিয়ে শংসাপত্র জোগাড় করছেন। অনেকে সরাসরি চক্রের দ্বারস্থ হচ্ছেন। চক্রের কাছে জনপ্রতিনিধিদের সিল, প্যাড, সই করা শংসাপত্র— সবই থাকে। সেগুলো নকল হতে পারে। আসলও হতে পারে। তার ভিত্তিতে আগে আধার কার্ড তৈরি করে, পরে ভোটার কার্ডে নাম-ঠিকানা পরিবর্তনের আবেদন করা হয়। সে জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের একাংশকে ‘প্রণামী’ দেওয়া হয়। যাচাই না হলে, সে সব ‘তথ্যের’ ভিত্তিতেই ভোটার-কার্ড মেলে।
তা ছাড়া, সামান্য টাকায় পুরনো ভোটার কার্ড জোগাড় করে তা থেকে কৌশলে ‘হলোগ্রাম’ তুলে নেওয়া হয়। যাঁর কার্ড কেনা হল, তাঁকে বলা হয়, কার্ড হারিয়েছে—এই মর্মে থানায় ডায়েরি করতে। পুরনো কার্ডে নতুন ছবি সেঁটে, তাতে ফের ‘হলোগ্রাম’ বসানো হয়। তা প্রিন্ট এবং ল্যামিনেশন হলেই তৈরি হয়ে যায় ভোটার কার্ড। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গিতে বাস থেকে ধরা পড়া এক বাংলাদেশির কাছে হাতে-গরম ভোটার কার্ড পেয়েছিল পুলিশ। সীমান্তবর্তী বিদুপুরের একটি ফটোকপির দোকানে কার্ডের সদ্য ‘ল্যামিনেশন’ করিয়ে তিনি চেপেছিলেন বাসে। তদন্তকারীদের দাবি, সর্ষের মধ্যে ভূত না থাকলে, এ সব চক্র চলতে পারে না। (চলবে)
তথ্য অনুসন্ধানে: নমিতেশ ঘোষ, সীমান্ত মৈত্র, সুস্মিত হালদার, সামসুদ্দিন বিশ্বাস, সুজাউদ্দিন বিশ্বাস, অভিজিৎ সাহা, সমরেশ মণ্ডল