যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতির একটা সমঝোতা হওয়ায় ভারত পাকিস্তান দুই দেশের বহু শান্তিকামী সাধারণ মানুষ হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এই সমঝোতাকে স্বাগতও
জানিয়েছে। অতীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ হয়েছে। আবার দ্বিপাক্ষিক স্তরে আলোচনার মধ্যে দিয়ে সমঝোতাও হয়েছে। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তির কথা আমাদের স্মরণে আছে। মনে আছে ’৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত মহাসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতির কথাও, যদিও— এ বারের প্রেক্ষিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ— সেই সময় সপ্তম নৌবহর কোনও হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সঙ্কট শেষ অবধি কোথায় গড়াবে, এ নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ উদ্বেগের মধ্যে ছিল। উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব গুতেরেসও।
যেটা চোখে পড়ার মতো, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি কার্যকলাপ নির্মূল করতে দলমত-নির্বিশেষে ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলই কেন্দ্রীয় সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। অতীতে এমনটা দেখা যায়নি। ভারতের বিদেশসচিব মন্তব্য করেছেন পহেলগামে জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা শুধু জম্মু-কাশ্মীরেই অশান্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়নি, এর লক্ষ্য ছিল সারা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা— দেশের মানুষ তা হতে দেয়নি। ভারতে সেনাবাহিনীর দুই নারী আধিকারিক প্রেস ব্রিফিং-এর সময় যে দক্ষতা ও সংযমের পরিচয় দিয়েছেন, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। ভারত যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং ভারতে যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ আছে তা-ও স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি।
পাশাপাশি এক বিরাট সংখ্যক মানুষের মধ্যে একটা তীব্র যুদ্ধ উন্মাদনা, তার সঙ্গে ঘৃণা ও বিদ্বেষের মনোভাবেরও সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কাছে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গি হামলা নির্মূল করার কাজটির থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে নির্মূল করার কাজটাই প্রাধান্য পাচ্ছে। উল্টো দিকে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অ-সামরিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক পদক্ষেপকে অনেক মানুষ বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। দুর্ভাগ্য, এ দেশে ক্রমেই এই মতের মানুষদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় দ্বিতীয় লাইনে লিখিত রয়েছে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র এই শব্দ ক’টি। ঠিক যে ১৯৭৬ সালে দেশে যখন জরুরি অবস্থা জারি ছিল, তখন ‘সোশ্যালিস্ট’ ও ‘সেকুলার’ কথা দু’টি সংবিধানে যুক্ত করা হয়। তবে মনে রাখা দরকার, সে বছর এই শব্দ দু’টিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও আসল ধারণাটি ভারতীয় জাতীয় চেতনায় অনেক দিন ধরেই আছে। ১৯৩০ সালে একটি বিতর্কে নেহরু উল্লেখ করেছিলেন রাজনৈতিক প্রাঙ্গণকে ধর্মীয় ভেদাভেদ থেকে মুক্ত রাখার কথা। এই প্রেক্ষিতেই তিনি সেকুলার শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তী কালের লেখায় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের পাঁচটি মূল মূল্যবোধের কথার উল্লেখ করেছিলেন। সেকুলারিজ়ম বা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ডেমোক্র্যাসি বা গণতন্ত্র শব্দ দু’টিকে বলেছিলেন ‘কো-টার্মিনাস’ বা সমসীমাযুক্ত। তিনি বলতে চেয়েছিলেন ভারতে অজস্র ধর্ম, জাতি, ভাষা, শ্রেণি, উপ-জাতি রয়েছে, যাদের সম-অধিকার মানলে ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্র হতে পারে না। তাই একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি জরুরি। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর নেহরু বলেছিলেন (১৯৫১) ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের উপর ভেদাভেদের আঁচ লাগতে দেওয়া চলবে না। তিনিই আইন প্রণয়ন করেছিলেন, নির্বাচনের সময়ে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না। ১৯৫১-৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ, রামরাজ্য পরিষদের মতো হিন্দুত্ববাদী পার্টিগুলি সর্বসাকুল্যে মাত্র ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। নেহরু বলেছিলেন, এটাই ভারতের মানুষের ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে একটি গণভোট। ১৯৫০ সালে গৃহীত ভারতের সংবিধানে ‘ফান্ডামেন্টাল রাইটস’ এবং ‘রাইট টু ইকোয়ালিটি’র কথা বলা আছে, যে শব্দগুলি কিন্তু পাকিস্তানের সংবিধানে নেই।
এও ঠিক যে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে একটা বিশেষ নিজস্বতা আছে। এ দেশে সকল ধর্মের রয়েছে সমান সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার। স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন সমস্ত ধর্মবিশ্বাসের প্রতি ভারতের সহনশীলতার কথা। মহাত্মা গান্ধী নিজেকে মনে করতেন সনাতনী হিন্দু। কোনও মানুষ বা ধর্ম বা দেশের প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণায় বিশ্বাস করতেন না। বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রতিও যথাযথ সম্মান দেওয়ার কথা। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে মুসলমানদের অনুরোধ জানাতে অনেক মসজিদে যেতেন গান্ধী। যেতেন এক জন সনাতনী হিন্দু হিসাবেই। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বললেও কোনও কালে উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন না। তিনি ছিলেন সমস্ত রকম যুদ্ধোন্মাদনা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে।
কেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার থেকে পৃথক? আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলিতে যেমন রাষ্ট্রের যে কোনও প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার থেকে বিরত থাকে, এমনকি স্কুল বা সরকারি প্রতিষ্ঠানেও। ভারতে মানুষের কিন্তু যে কোনও ধর্মে বিশ্বাস করার অধিকার আছে। বিভিন্ন ধর্মের নিজস্ব নিয়ম, বিধি, প্রথা চালু রাখার পক্ষেই এই রাষ্ট্র, যদিও কোনও কোনও ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধি পরিবর্তনে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপও করতে পারে। যেমন হিন্দু ধর্মে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ বন্ধ করা, মহিলাদের ডিভোর্স করার অধিকার দেওয়া, উত্তরাধিকার সূত্রে মেয়েদের পারিবারিক সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার বিষয়ে ভারতীয় রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করেছে।
হিন্দু ধর্মে নিম্নবর্গের মানুষদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার ছিল না, সরকারের আইনেই সেই অধিকার এসেছে। যদিও হিন্দুত্ববাদীরা এ সব প্রস্তাবের বিরোধিতা করার পরেও এ সব সংস্কার এ দেশে ঘটেছে। কিছু প্রাক্তন দেশীয় রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে মন্দির পরিচালনায় ট্রাস্টে সরকারি আধিকারিকরা থাকেন। কোচবিহার, ত্রিপুরা বা বিভিন্ন প্রাক্তন দেশীয় রাজ্যগুলিতে আজও মন্দির পরিচালনায় সরকারি অর্থ ব্যয় হয়। কেরলে রয়েছে রাজ্য বাজেটে মন্দির পরিচালনায় আর্থিক বরাদ্দ। এর জন্যে রয়েছে দেবস্বম বোর্ড। যেমন ইসলাম ধর্মের জন্য আছে ওয়াকফ বোর্ড। দু’টি ক্ষেত্রেই স্ব স্ব ধর্মের প্রতিনিধিরা ট্রাস্টে থাকেন। আদালতের নির্দেশে কোনও ধর্মকে সংখ্যালঘু ধর্মের স্বীকৃতিও দেওয়া হয়ে থাকে, যেমন জৈন ধর্মের ক্ষেত্রে। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সর্বধর্মের প্রতি সমভাব বা সব ধর্মের সমান অধিকার, তাদের মধ্যে সমন্বয় বিধানের চেতনা। এই দিক থেকে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে গণতন্ত্রের মূল্যবোধের গভীর সংযোগ।
তাই আজকের ভারতে একটি যুদ্ধ যেমন সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি কার্যকলাপকে নির্মূল করার লক্ষ্যে, তেমনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বজায় রাখা এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সুরক্ষিত রাখার যুদ্ধও চলছে পুরোদমে। পহেলগামে জঙ্গি হামলার উদ্দেশ্য ছিল এই হামলার প্রতিক্রিয়াকে ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে দীর্ঘকালের যে ঐক্য রয়েছে তাকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। ভারতের মানুষ অনেকাংশেই তা করতে দেয়নি। তারা জাতীয় ঐক্যকে অটুট রেখেছে। এতে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদীরা হতাশ হয়েছে। এরা জানে ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি নিহিত রয়েছে এখানেই। অন্য দিকে, এক দল ভক্তকুল যারা দেশের সকল জাতি, ধর্মের মানুষের ঐক্য চায় না, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের মূল্যবোধে বিশ্বাস করে না, যারা চেয়েছিল যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক, তারা ক্রমেই হতাশ হচ্ছে।
আপাতত এই যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে এটাই বড় প্রাপ্তি। বহু মূল্যের এই প্রাপ্তিকে সুরক্ষিত রাখা আমাদের কাছে একটি অত্যন্ত জরুরি কাজ।