মর্মান্তিক
সম্প্রতি নদিয়া জেলার কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়। বেশ কয়েক রাউন্ড গণনার পর শাসক দলের প্রার্থীর জয় নিশ্চিত হতেই তারা এলাকায় মিছিল বার করে। সাধারণত গণনা কেন্দ্রে যে দলের প্রার্থী এগিয়ে থাকে, সেই দলের সমর্থকরা সেখানেই উল্লাস করেন। আর বিজয় মিছিল হয় সরকারি ভাবে প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করার পর। কিন্তু কালীগঞ্জের মানুষ এ ক্ষেত্রে শাসক দলের এক অন্য রূপ দেখল। তারা গণনা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রার্থীর জয় নিশ্চিত হওয়ার উল্লাসে বোমা ছুড়তে ছুড়তে বিজয় মিছিল করতে শুরু করে। বেছে বেছে সিপিএম সমর্থকদের বাড়িতে বোমা মারে। শাসক দলের উল্লাসে সকেট বোমায় বছর দশেকের শিশু তামান্না খাতুনের প্রাণ যায়। তার মৃত্যুতে গোটা এলাকা ক্ষোভে ফুঁসছে। তাঁরা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সরব। তামান্না খাতুনের মা জেলার পুলিশ সুপারের কাছে বলেছেন, যারা মিছিলে ছিল তাদের চিনি, তাদেরও যেন এ ভাবে মৃত্যু হয়।
ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক, নিন্দাজনক ও পৈশাচিক। কেবলমাত্র একটি উপনির্বাচনের জয়কে কেন্দ্র করে শাসক দলের বোমাবাজিতে ফুলের মতো একটি শিশুর অকালে চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ঘটনায় দোষীদের কাউকেই ছাড়া হবে না। সকলকেই গ্রেফতার করা হবে। ইতিমধ্যে কয়েক জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু তাতে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না কেউই। কারণ অভিজ্ঞতা বলে, যে কোনও ঘটনা ঘটলেই শাসক দল ও প্রশাসন থেকে গতে বাঁধা এই কথাগুলিই বলা হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় তাদের বিরুদ্ধে এমন ভাবে কেস দেওয়া হয়েছে, যাতে কিছু দিন জেলে থাকার পর সহজেই অপরাধীরা জামিন পেয়ে যায়। আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। শাসক দলের একটি উপনির্বাচনে জয়ের এই লাগামছাড়া উল্লাসে রাজ্যের মানুষ শঙ্কিত ও আতঙ্কিত। তাঁদের মনে প্রশ্ন উঠছে, রক্তপাত ও মৃত্যু ছাড়া এই রাজ্যে কি কোনও নির্বাচন সম্পন্ন হতে পারে না?
অথচ, নির্বাচনে একটি দল জিতবে, অন্য দলগুলি হারবে— এটাই সমস্ত গণতন্ত্রের মূল কথা। তাই সেই ফলাফলকে সুস্থ মস্তিষ্কে, যুক্তি দিয়ে মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলাই রাজনৈতিক দলগুলির প্রধান কর্তব্য হওয়া প্রয়োজন। কেউ সেই সাধারণ কথাটি বিস্মৃত হলে তার শাস্তি জরুরি। তামান্না খাতুনের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে গ্রেফতার করে দ্রুত ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করুক রাজ্য সরকার।
অপূর্বলাল নস্কর
ভান্ডারদহ, হাওড়া
প্রশ্ন মূল্যায়নে
গত শিক্ষাবর্ষ থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে সিমেস্টার পদ্ধতি চালু হয়েছে। চারটি সিমেস্টারের মধ্যে প্রথমটিতে থাকছে এমসিকিউ টাইপ প্রশ্ন। প্রতিটি বিষয়ে চল্লিশ নম্বরের প্রশ্নপত্র। কিন্তু দ্বিতীয় সিমেস্টারের পরীক্ষায় ছোট-বড় প্রশ্ন মিলিয়ে যে চল্লিশ নম্বরের পরীক্ষাটি হচ্ছে, তাতে ছাত্রছাত্রীদের বেশ কয়েক পাতা উত্তর লিখে আসতে হচ্ছে। এখন এই দীর্ঘ উত্তর লেখার অভ্যাসটি এক জন ছাত্র বা ছাত্রী ছেড়ে এসেছে মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে। একাদশ শ্রেণির প্রথম সিমেস্টারের পরীক্ষায় এমসিকিউ উত্তরে দাগ দিয়ে এসেছে সে। ফলে পূর্ণবাক্যে উত্তর লেখার অনভ্যাস তৈরি হয়েছে। পুরো বই খুঁটিয়ে পড়ানোর জন্য মাস্টারমশাইদের হাতেও বরাদ্দ সময় যথেষ্ট কম। এ দিকে সিলেবাসের বিপুল বোঝা। ফলস্বরূপ ছাত্রছাত্রীরা বাজারচলতি নোটবুক থেকে এমসিকিউ প্রশ্নোত্তর তৈরি করে পরীক্ষা হলে ঢুকছে। প্রথম ধাপটি মোটামুটি সম্মানজনক ভাবে উতরে গেলেও তারা সত্যিকারের বিপদে পড়ছে দ্বিতীয় সিমেস্টারে এসে।
মাধ্যমিক পরীক্ষা হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সিমেস্টারের পরীক্ষা হচ্ছে এপ্রিলে। পুরো চোদ্দো মাসের ব্যবধানে ছাত্রছাত্রীরা পুনরায় পূর্ণবাক্যে উত্তর লিখে পরীক্ষা দিচ্ছে। এখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকানো যাক। এই বছরে প্রথম হওয়া নতুন পাঠ্যক্রমের দ্বিতীয় সিমেস্টারে পাশের হার বিদ্যালয় সাপেক্ষে ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি নয়। সব বিষয়ে পাশ করেছে এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হাতেগোনা। পুরো চল্লিশ নম্বরের পরীক্ষায় দিতে পারেনি বহু ছাত্রছাত্রী। উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ তাদের পোর্টালে নম্বর তুলে দিতে বলেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেছে। একাদশে অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীরা পুনরায় একাদশ শ্রেণিতেই পড়বে— এই মর্মে গেজ়েট নোটিফিকেশন আছে ঠিকই, কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীকে পুনরায় একাদশ শ্রেণিতেই পড়তে হলে ড্রপ-আউট সংখ্যা আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। সংসদ এত দিন বলেছিল এ বিষয়ে স্কুল সিদ্ধান্ত নেবে। সম্প্রতি দ্বিতীয় সিমেস্টারেও পুনরায় সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা নেওয়ার কথা সংসদ জানিয়েছে। কিন্তু তাতেও কি সমস্যা মিটবে? সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দিতে কত জন ছাত্রছাত্রী আসবে, সন্দেহ থেকে যায়। কারণ দ্বিতীয় সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষাটিও তো সেই ছোট-বড় প্রশ্নের উত্তর লিখেই দিতে হবে। এই পরীক্ষাতেও অকৃতকার্য হলে তারা ক্রমশ স্কুলবিমুখ হবেই।
সংসদের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে এখানেই প্রশ্ন তোলা যায়। প্রথম সিমেস্টারের পরীক্ষাটি পূর্বের মতোই লিখিত পরীক্ষা নেওয়া যেত। দ্বিতীয় সিমেস্টার এমসিকিউ টাইপ হলে ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধা থাকত না। তৃতীয় সিমেস্টারে কিছুটা এমসিকিউ এবং কিছুটা লিখিত উত্তরধর্মী প্রশ্ন মিলিয়ে-মিশিয়ে রাখা দরকার ছিল। ফলে শিক্ষার্থীদের খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যাস যেমন তৈরি হত, তেমনই লেখার অভ্যাসটাও থাকত। এতে দ্বাদশ শ্রেণির ফাইনাল সিমেস্টারে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর অকৃতকার্য হওয়ার ঘটনা ঘটবে না। একাদশ শ্রেণির প্রথম সিমেস্টার হতে এখনও দেরি আছে। সংসদ কি মূল্যায়নের পদ্ধতি নিয়ে আর এক বার চিন্তাভাবনা করবে?
সৌমেন চট্টোপাধ্যায়
সেহারা, পূর্ব বর্ধমান