বন্ধুর সন্ধান
সার্কাসের সব রকম দড়ির খেলা একই পরিমাণ শক্ত হয় না। খেলোয়াড়ের দক্ষতার উপর নির্ভর করে সাব্যস্ত হয়, খেলাটা কত শক্ত করা হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাস্তবে রাজনীতি ও কূটনীতির দড়ির খেলা কখন কতটা কঠিন হবে, সেটা খেলোয়াড়রা আগে থেকে জানতে পারেন না, দক্ষ হয়ে উঠতেও পারেন না। ভারতের পরিস্থিতি এখন সেই রকম। জুন মাসে পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধ বুঝিয়ে দিল, কতটাই কঠিন ভারসাম্য-খেলার পরীক্ষা শুরু হয়েছে দিল্লির জন্য। ইরান এবং ইজ়রায়েল, দু’টি দেশই ভারতের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ইরানের সঙ্গে মিত্রতার দীর্ঘ ঐতিহ্য এবং কূটনৈতিক সহযোগিতা ভারতের পক্ষে জরুরি, চাবাহার বন্দরের বিষয়ে ভারত ও ইরান দুই দেশই বিশেষ আগ্রহী, নিজ নিজ স্বার্থের কারণে। ঠিক তেমনই, অতি প্রয়োজনীয় ইজ়রায়েলের সঙ্গে মৈত্রী। প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত দিক থেকে ভারতের পক্ষে এর সমান সক্ষম ও শক্তিমান ‘বন্ধু’ নিকটবলয়ে আর কেউ নেই। গত এক দশকে ইজ়রায়েলের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা অনেক গুণ বেড়েছে— কতটা তা এ বারের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেই প্রমাণিত হল। প্যালেস্টাইনে গাজ়াতে ইজ়রায়েলি আক্রমণ বিষয়েও ভারতকে খুব সতর্ক পদক্ষেপ করতে হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হল, ইজ়রায়েলের সঙ্গে এই ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা ক্রমশই ভারতকে এমন অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে দিল্লির পক্ষে অবস্থান নেওয়াও যত কঠিন, একটি পর্যায়ের পর অবস্থান না নেওয়াও ততই কঠিন। সুসংবাদ যে ইরান-ইজ়রায়েল সংঘর্ষ সেই পর্যায়ে যাওয়ার আগেই যুদ্ধ স্তিমিত হল। যুদ্ধরত দেশগুলিই কেবল বাঁচল না, ভিন্ন অর্থে বেঁচে গেল ভারতও। গাজ়ায় সেই সম্ভাবনা নেই— তবে কিনা গাজ়ার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক ‘দাম’ কম দিতে হবে বলে কেবল ভারত নয়, বিশ্বের প্রায় কোনও দেশই এই অভাবনীয় আক্রমণ-পর্বে ইজ়রায়েলের নিন্দা করেনি— এমনকি পশ্চিম এশিয়ার অন্য ইসলামি দেশগুলিও নয়।
লক্ষণীয়, এই কারণেই গত কিছু কাল ধরে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে চলছে ভারত। ‘ব্লক-বেসড কনফ্রন্টেশন’ বা কোনও গোষ্ঠীগত বোঝাপড়ার মধ্যে প্রবেশ করলে যে পরিস্থিতিবিশেষে খুব চড়া দাম দিতে হতে পারে, সে কথা বুঝে দিল্লি গত কয়েক বছরে দ্বিপাক্ষিকতার উপর জোর দিয়ে এসেছে। এই কারণে ভারতের কূটনৈতিক বুদ্ধির প্রশংসাও হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। কিন্তু এত দিনে এও স্পষ্ট হচ্ছে— দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রেখে পশ্চিম এশিয়ায় যদিও বা মুখরক্ষা সম্ভব, দক্ষিণ এশিয়ায় কিন্তু ভারত বড় কূটনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া একেবারেই কাজ করেনি এই অঞ্চলে, গোষ্ঠী মিত্রতাও নয়। বরং অতি সম্প্রতি ১৯ জুন কুনমিং-এ চিন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হল— প্রথম বার— সেখানে সকলেরই প্রধান ‘অপর’ শক্তি দেশ যে ভারত, তা গ্রীষ্মের রৌদ্রের মতো খরোজ্জ্বল। পাকিস্তান ভারত সংঘর্ষের পর যে ভাবে পাকিস্তান প্রায় সব দেশের কাছে ‘ক্লিন চিট’ বা স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছে, রাষ্ট্রপুঞ্জে সন্ত্রাসবিরোধী বৃত্তে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের অর্থসাহায্য পেয়েছে এবং এসসিও-তে ভারতের বিপরীতে পাকিস্তান কূটনৈতিক লাভ জোগাড় করেছে, এ সবে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। অনেক দিনের ঐতিহ্য ভেঙে ঢাকা এখন খোলাখুলিই দিল্লির বদলে ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে একাধিক বার বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উচ্চতম পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে, ১৯৭১ সালের পর থেকে প্রথম বার এই দুই দেশ গত মার্চ থেকে সরাসরি বাণিজ্যসম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে ইসলামি কট্টরপন্থার প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনাই ভারতের জন্য একমাত্র বিপদ নয়, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ভাবেও এই নতুন (ভারতবিরোধী) অক্ষ এত দিনের ভারসাম্য টলিয়ে দিতে পারে। ইতিমধ্যেই একা দিল্লির জন্য একাকিত্ব আরও বাড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে এখন ভারতের প্রথম জরুরি কাজ, নতুন মিত্রসন্ধান। প্রশ্ন হল, কে সে?