পুরনো সব সময় নতুনকে সাগ্রহে জায়গা দিতে চায় না। এমনকি, নতুন যদি তার যাবতীয় সম্ভাবনা-সহ সামনে এসে দাঁড়ায়, ভবিষ্যতের পথ চলায় তার অপরিহার্যতা
প্রমাণও করে ছাড়ে— তবুও। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়ে এখনকার বিশ্বের ভাব অনেকটা সে রকমই। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এআই-এর প্রয়োগ হয়ে উঠেছে সর্বাত্মক, রোজকার জীবনধারায় ও সমাজমাধ্যমে তার এক অতি ক্ষুদ্রাংশই প্রতিফলিত হয় মাত্র। কিন্তু উন্নত দেশগুলি এআই-গবেষণায় যে বিপুল শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় করছে, এআই সংস্থাগুলির কার্যকলাপ গত কয়েক বছরে যে ভাবে খবরের শিরোনাম হয়ে উঠেছে তা থেকে পরিষ্কার— ভবিষ্যৎ সমাজ সর্বার্থেই হবে এআই-ময়, অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
এআই, বিশেষত জেনারেটিভ এআই-এর ‘বিরুদ্ধে’ মানুষের পৃথিবীর অভিযোগ খুব সোজাসরল ভাবে বললে এই মৌলিক জায়গাটা থেকে— মানুষেরই সৃষ্ট বিপুল তথ্যভান্ডার যান্ত্রিক দ্রুততায় আত্মসাৎ করে এআই মানব-বুদ্ধির শিক্ষণের ধরন বা ‘লার্নিং প্যাটার্ন’ আয়ত্ত করে নেবে, তার পর ‘সৃষ্টি’ও করবে মানুষের মতোই— সেই সৃষ্টি ছবি, কথা, লেখা, সঙ্গীত, যা-কিছুই হোক, যত সৃষ্টিশীল, জটিল, বৌদ্ধিকই হোক। এরই মধ্যে তার নানা নমুনা দেখা যাচ্ছে চোখের সামনে, বিশেষত সমাজমাধ্যমে। তাতে যা বোঝা যাচ্ছে তা রোমাঞ্চ জাগানোর মতো: অতিপ্রাচীন এক সভ্যতায় মানুষের জীবন কেমন ছিল তা জীবন্ত করে তোলা যাচ্ছে, গতায়ু নায়ক-গায়কের শরীরী অভিনয় ও কণ্ঠসুষমা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে, শেক্সপিয়রের মতো সনেটও লিখে ফেলা যাচ্ছে— এআই দিয়ে। রোবট বা ড্রোন দিয়ে তো মানুষের বদলি বহু কাজ করে ফেলা যাচ্ছিলই, এ বার এআই এসে পড়ায় এই ভয় জাঁকিয়ে বসেছে যে মানুষের চাকরি আর থাকবে না। সেই ভয় সত্যও হয়েছে, বিশ্বের নানা দেশে বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তির বনিয়াদি স্তরে কর্মরত বহু মানুষ কর্মচ্যুতও হয়েছেন, তাঁদের কাজ এখন এআই দিয়েই সেরে ফেলা যাচ্ছে বলে। এর পরেও একটা ‘আশা’ ছিল, এখনও আছে যে, যতই হোক এই বুদ্ধিমত্তা তো কৃত্রিম, তার আবেগ নেই, তার ভাবনাও প্রকৃত মানুষের মতো নয়, সুতরাং সে কী করে মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠবে! তার সৃষ্টি আপাতসুন্দর হতে পারে, কিন্তু সমসময় ও আবহমানের হাত-ধরাধরিতে যে চিত্রকর গ্যেরনিকা আঁকেন, যে কবি দি ওয়েস্ট ল্যান্ড লেখেন, যে ভাস্কর কলের বাঁশি গড়েন, এআই তাঁদের ধারেকাছেও কি পৌঁছতে পারবে কখনও— ওই সৃষ্টিগুলির অবিকল প্রতিরূপ গড়ে তোলার পরেও? দুর্গাপুজোর যে শিল্পযজ্ঞের সাক্ষী এই মুহূর্তের কলকাতা, সেই উৎকর্ষ কি অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে জেনারেটিভ-এআই ছুঁতে পারবে?
এই উত্তর রয়েছে অনাগত কালের গর্ভেই। তবে প্রযুক্তি-তাত্ত্বিকরা বলছেন, এআই-কে তাচ্ছিল্য না করে বরং তার সঙ্গে এক প্রকার শর্তাধীন সন্ধি করাই একুশ শতকের মানুষের শ্রেয়। ইতিহাস বেয়ে এ ভাবেই একটি প্রযুক্তির যুগ শেষ হয়ে অন্য একটি প্রযুক্তি এসেছে, হয়তো সেই যুগান্ত অত্যন্ত বা যথেষ্ট ধীরে হয়েছে বলে সে পরিবর্তনকে মেনে নিতে তত বেগ পেতে হয়নি। একুশ শতকে এই পাল্টে-যাওয়াই হচ্ছে অতি দ্রুত, তাই সর্বাধুনিক এআই-কে গ্রহণ করতে মানুষের আঁতে লাগছে বেশি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অতি সম্প্রতি রীতিমতো ঘোষণা করে তাদের সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-কর্মীদের জন্য ‘চ্যাটজিপিটি’র সর্বোচ্চ স্তরের পরিষেবা বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, যা অনিবার্য তাকে ঐতিহ্যের দোহাই পেড়ে আটকে লাভ নেই, বরং আজ এআই-এর সুস্থ, নৈতিক ও নিরাপদ প্রয়োগ সম্বন্ধে জানলে পড়াশোনা শেষ করে বাইরের জগতে সেই জ্ঞান কাজে দেবে, প্রাক্তনীরাই বরং হয়ে উঠতে পারে এআই-জগতে দিশারি। ‘সুস্থ, নৈতিক ও নিরাপদ প্রয়োগ’ শব্দগুলি অতি জরুরি, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এআই-কে যথার্থ ব্যবহারের বার্তা।