জীবনদায়ী
শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের ধমকেই কাজ হল। ২০১৯ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে মোটর ভেহিকলস অ্যাক্ট, ১৯৮৮-র অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল পথ-দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার জন্য ‘ক্যাশলেস’ পরিষেবার ব্যবস্থা করার নীতিটি। তার পর ছ’বছর কেটে গেলেও কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পটি চালু করে উঠতে পারেনি। শেষ অবধি শীর্ষ আদালত নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিল। অতঃপর, কেন্দ্রীয় সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রকল্প চালু হওয়ার কথা ঘোষণা করল। স্বাস্থ্যবিমা নেই, পথ-দুর্ঘটনায় আহত এমন যে কোনও ব্যক্তিকে দেশের ৩০,০০০ নির্দিষ্ট হাসপাতালে প্রথম সাত দিনের চিকিৎসার খরচ বাবদ দেড় লক্ষ টাকা অবধি দেবে সরকার। আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা হলে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা আরম্ভ করতে হবে। আইন বলছে, আহত ব্যক্তি যাতে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ অর্থাৎ দুর্ঘটনা-পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা পান, তা নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা। প্রকল্পটির গুরুত্ব নিয়ে সংশয় নেই। কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে গোটা দেশে চার লক্ষ আশি হাজারেরও বেশি পথ-দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তাতে মোট প্রাণহানির সংখ্যা ছিল এক লক্ষ বাহাত্তর হাজারের বেশি। ন্যাশনাল ল কমিশনের বিশ্লেষণ অনুসারে, এই মৃত্যুর অন্তত অর্ধেক রোধ করা যেত, যদি আহত ব্যক্তিকে দুর্ঘটনা ঘটার এক ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া যেত। আলোচ্য প্রকল্পটি এই অনর্থক প্রাণহানি রোধের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গোটা দেশে এই প্রকল্পটি চালু করতে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মোট ২৭২ কোটি টাকা। প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দটি অবশ্য সামান্যই— প্রতিটি দুর্ঘটনায় গড়ে মাত্র এক জন লোকের ১.৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ের চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। গুরুত্ব বুঝে প্রকল্পের বরাদ্দ বৃদ্ধি জরুরি।
পথ-দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা হলেও তাঁর চিকিৎসা হয় না, কারণ চিকিৎসার খরচ কে মেটাবে, সে নিশ্চয়তা নেই— এই পরিস্থিতিটি দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাস্তব। হাসপাতালগুলিকেও দোষ দেওয়া মুশকিল, কারণ মানবিকতার ধর্মের সঙ্গে বাণিজ্যের ধর্মের সম্পর্কটি বহু ক্ষেত্রেই সমানুপাতিক নয়। চিকিৎসার খরচ মেলার নিশ্চয়তা থাকলে হাসপাতালগুলিও অনেক সহজে এবং দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারবে। তবে, একটি গোলমালের অবকাশ থেকেই গিয়েছে। সরকারনির্দিষ্ট ৩০,০০০ হাসপাতালেই এই সুবিধাটি মিলবে— দুর্ঘটনার পর আহতকে অন্য কোনও হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা করে রোগীকে নিয়ে যেতে হবে নির্দিষ্ট হাসপাতালে। এই ব্যবস্থার পিছনে প্রশাসনিক কারণটি বোঝা সহজ। কিন্তু, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এতেও রোগীর স্বার্থহানি ঘটতে পারে। সহজতর উপায় ছিল এমন বিমার ব্যবস্থা করা, যা প্রতিটি হাসপাতালের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। ভারতে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা মূলত বিমাভিত্তিক। ফলে, পথ-দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থা করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যে-হেতু এই প্রকল্পের অধীনে চিকিৎসার ব্যয়ের ঊর্ধ্বসীমাটি নির্দিষ্ট, ফলে খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা নিয়েও চিন্তার কারণ নেই। নাগরিকের কথা ভেবে শেষ অবধি যখন প্রকল্পটি চালু হলই, তখন সম্পূর্ণ স্বার্থরক্ষা করাই বিধেয়।