মাত্র অর্ধেক পরীক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেছে ফরাক্কার একটি স্কুলে— ৯১৪ জন ছাত্রের মধ্যে ৪৪৮ জন ফেল। যদিও রাজ্যে অনুত্তীর্ণের হার ১৪ শতাংশ, তবু এই স্কুলটিকে ব্যতিক্রম বলা চলে না। জেলাওয়ারি সমীক্ষায় বার বার দেখা গিয়েছে যে ব্যর্থতার হার সমান নয়— পাশের হারের নিরিখে জেলাগুলির একটি ক্রম নির্দিষ্ট হয়েই রয়েছে। বরাবরই তার উপর দিকে থাকে পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, আর নীচের দিকে জলপাইগুড়ি, পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুর। জেলাগুলির মধ্যেও যদি ব্লক ও মহল্লা অনুসারে বিশ্লেষণ করা যায়, তা হলে পাঠ-বঞ্চনার কারণগুলির আরও নিবিড় ছবি ফুটে ওঠে। ফরাক্কার ওই স্কুলের ছাত্রদের অধিকাংশই নানা ধরনের রোজগারে যুক্ত হয়ে পড়েছে, ছুটির সময়ে তারা পড়াশোনার দুর্বলতা মেরামত না করে কোনও একটা কাজে লেগে পড়ে, কিছু টাকা পাওয়ার চেষ্টায় থাকে। জলপাইগুড়ি জেলায় মেয়েদের পাশের হার সর্বনিম্ন, মাত্র ৬৯ শতাংশ। তা কি চা বাগানে মেয়েদের শ্রমের সঙ্গে সম্পর্কহীন? কখনও ঘরের কাছে, কখনও অন্য শহরে, বা ভিন রাজ্যে কায়িক শ্রমের কাজ করতে জুটে যাচ্ছে স্কুলের ছাত্ররা। ফলে স্কুলছুট বা ‘ড্রপ আউট’-এর হার ছাত্রদের মধ্যে বেশি। রাজ্য সরকার নিজের মুখ বাঁচাতে বরাবরই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা শূন্য, এবং স্কুলছুটদের সংখ্যা অতি নগণ্য বলে দেখায়। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল কিন্তু বাস্তব তথ্যটা বলে দেয়। এ বছর মাধ্যমিক-উত্তীর্ণ হয়েছে সাত লক্ষ একানব্বই হাজার ছাত্রছাত্রী, যাদের মধ্যে ছাত্র তিন লক্ষ আটষট্টি হাজার, আর ছাত্রী চার লক্ষ বাইশ হাজার। এ বছর ফারাক চুয়ান্ন হাজার, গত বছর ছিল আটচল্লিশ হাজার। কিশোরদের স্কুলছুটে এই বৃদ্ধি কী করে আটকানো যায়, তার কোনও নীতি বা পরিকল্পনা করছে সরকার, এমনও দেখা যাচ্ছে না। সাংবাদিকরা খোঁজ করে দেখেছেন, স্কুলছুট ছাত্রদের অভিভাবকরাও ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-সহ নানা ধরনের সরকারি অনুদান পেয়ে থাকেন। সাইকেল, ট্যাবও মিলে থাকে।
তেমনই, মেয়েরা পাশের হারে কেন বরাবর পিছিয়ে থাকছে, সে প্রশ্নটাও করা চাই। ২০২৪ এবং ২০২৫, দু’টি বছরেই ছাত্রদের পাশের হার ৮৯ শতাংশ, যেখানে ছাত্রীরা আটকে রয়েছে ৮৩-৮৪ শতাংশে। কন্যাশ্রী প্রকল্প যদি বা কিছু বাড়তি মেয়েকে স্কুলে রাখতে পেরে থাকে, তাদের পড়াশোনার মান বাড়াতে পারছে না। তার জন্য যা জরুরি— স্কুলের পঠন-পাঠনের মান, সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা— নিয়োগ কেলেঙ্কারির পর থেকে সে কথাটা সরকার কেবলই এড়িয়ে চলতে চায়। তবে সরকারি ব্যর্থতার প্রধান পরিমাপ স্কুলছুটের সংখ্যা। শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) বা নয়া শিক্ষানীতি (২০২০) যা-ই নির্দেশ দিক, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির মধ্যে স্কুলছুট অব্যাহত। কেন্দ্রের শিক্ষা মন্ত্রকের ‘প্রোজেক্ট অ্যাপ্রুভাল বোর্ড’ (পিএবি) বার বার রাজ্য-প্রদত্ত পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কোভিডের আগেই এই হার ছিল উদ্বেগজনক। ২০১৯-২০ সালের জাতীয় পরিসংখ্যানে প্রাথমিকে রাজ্যের স্কুলে ধরে-রাখার হার (প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি) ৬২ শতাংশ, এবং মাধ্যমিক (নবম-দশম) ৪৭ শতাংশ, মনে করিয়েছে পিএবি। তাঁদের হিসাব, কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রী স্কুলের বাইরে।
মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিন জোর দেওয়া হয় প্রথম-দ্বিতীয় স্থানাধিকারীদের নাম ঘোষণায়। সেই ‘আশ্চর্য’ কিশোর-কিশোরীদের সাফল্যের রহস্য নিয়ে মেতে ওঠে সংবাদমাধ্যম, উদ্যাপনের উল্লাসে লক্ষ লক্ষ শিশুর শিক্ষাবঞ্চনা চাপা পড়ে যায়। পাশাপাশি চাপা পড়ে রাজ্যের ব্যর্থতা, পরিকল্পনার দিশাহীনতা। প্রশ্ন তোলা জরুরি— এই রাজ্য কি সাম্যময়, রোজগারমুখী, উন্নয়ন-উপযোগী শিক্ষা-পরিকাঠামো তৈরির পরীক্ষায় পাশ করল? প্রথম-দ্বিতীয়দের রসগোল্লা খাওয়ার ছবি দেখে কি কয়েক লক্ষ শিশুর শিক্ষাবঞ্চনা, রাজ্যের মেধাসম্পদের বিনাশ ভুলে থাকা যাবে?