বহু প্রতীক্ষিত এক গেট টুগেদারের সন্ধ্যা। কী পরবেন, কী ভাবে সাজবেন, এক সপ্তাহ আগে ঠিক করে রেখেছেন। বিকেলে কসমেটিকস ভান্ডার খুলে আয়নার সামনে বসতেই মনটা চুরমার হয়ে গেল! এ মা, কপালে পিম্পল! কোনও প্রডাক্টের ভুল প্রয়োগে হয়েছে নিশ্চয়ই। ম্যাট কনসিলার, সেটিং পাউডার দিয়ে ত্বকের এই ত্রুটিটা না হয় ঢাকা গেল, কিন্তু তাতে তো পিম্পল উধাও হল না। বরং সংবেদনশীল জায়গায় প্রসাধনী প্রয়োগের ফলে লালচে ভাব আরও বাড়ারই আশঙ্কা। আর ফাউন্ডেশন ব্যবহারে মুখটা উজ্জ্বল হল ঠিকই। কিন্তু নাকে ব্ল্যাকহেডসের কারণে কিছুতেই স্কিন টোনে সামঞ্জস্য আসছে না।
ঠিক এই ধরনের সমস্যাগুলিরই সমাধান করছে নারিশিং কসমেটিকস বা ডার্মোকসমেটিকস। ত্বকচিকিৎসক যে ওষুধ সংস্থার প্রসাধনী ব্যবহারের নিদান দেন, সেগুলোরই পোশাকি নাম ডার্মোকসমেটিকস। সৌন্দর্য সচেতনদের দুনিয়ায় এর দারুণ কদর। তার কারণ, ‘গ্লাস স্কিন’ এখন ট্রেন্ডে। সেটা পেতে হলে ত্বকের স্বাস্থ্যরক্ষা খুব প্রয়োজনীয়। ত্বক সুস্থ থাকলে তবেই তো তার জৌলুস বাড়বে। তাই এমন প্রসাধনীর চাহিদা বাড়ছে যা ত্বকের রোগ-ঝঞ্ঝাট সারিয়ে দেখতে সুন্দর করে। ডার্মোকসমেটিকসের গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা করলেন বিশেষজ্ঞরা।
কেন এত নিরাপদ
প্রসাধনী সংস্থাগুলোর দাবি, এতে উপকারী উপাদান, ভিটামিন, মিনারেল আছে। এগুলি প্রধানত কসমেসিউটিক্যালস। ত্বকচিকিৎসক সন্দীপন ধর বললেন, “এগুলি ইউএসএফডিএ-র (ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) দ্বারা অনুমোদিত নয়। এগুলি থেকে কোনও ক্ষতি হলে তার দায়িত্ব এই সংস্থা নেয় না। সারা বিশ্ব কিন্তু ওষুধের ক্ষেত্রে ইউএসএফডিএ-র শংসাপত্রকেই মান্যতা দেয়। কারণ কোনও ওষুধ বা মলম এই সংস্থার কাছে গেলে তাকে বেশ কতকগুলি পরীক্ষার ধাপ পেরোতে হয়। তার পর সেটি বাজারে আসার, মানবদেহে প্রয়োগের ছাড়পত্র পায়। কসমেটিকসের ক্ষেত্রে কিন্তু এই অনুমোদন দেওয়ার দায় সংস্থাটি নেয় না। অর্থাৎ এর প্রয়োগে কোনও ক্ষতি হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। সোজা কথায়, এই সব প্রডাক্ট ব্যবহারে ঝুঁকি আছে। সেগুলো নিজের দায়িত্বে জেনে বুঝেই ব্যবহার করুন।”
তবে সাধারণত ভাল ব্র্যান্ডের প্রসাধনীতে বড় ক্ষতি হয়েছে বলে তেমন শোনা যায় না। কিন্তু ত্বকে ছোটখাটো সমস্যা তো প্রায়ই হয়। যেমন ব্রণ, ফুসকুড়ি, চামড়া শুকিয়ে যাওয়া, অ্যালার্জির সমস্যা ইত্যাদি। ডা. ধর সাবধান করলেন, “কসমেটিকস ব্যবহার করে ত্বক পুড়ে গিয়েছে, এমন উদাহরণও আছে। এ দিক দিয়ে ওষুধের সংস্থা যে প্রসাধনীগুলি নিয়ে এসেছে সেগুলি অনেক নিরাপদ। এগুলি আমেরিকার একটি বিশেষ আইনের ভিত্তিতে ছাড়পত্র পেয়েছে। ফলে ওষুধ কোম্পানির ময়শ্চারাইজ়ার, ফেস ওয়াশ, লিকুইড সাবান, সানস্ক্রিন, নাইট ক্রিম, সেরাম, শ্যাম্পু ইত্যাদি ব্যবহারের ঝোঁক বাড়ছে। এই ডার্মোকসমেটিকসে হয়তো বাজারে জনপ্রিয় প্রডাক্টের মতো চটক বা সৌরভ নেই। কিন্তু এগুলি বিজ্ঞানসম্মত। বরং দেখা গিয়েছে, যে প্রডাক্ট সুগন্ধে ভরা, তার থেকে কনট্যাক্ট অ্যালার্জি হচ্ছে। ৯৯.৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই ডার্মোকসমেটিকসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই আর সৌন্দর্যবৃদ্ধিও করে।”
এই সব সংস্থা এখন রেডিয়্যান্স ক্রিমও এনেছে, যেগুলি ফাউন্ডেশনের পরিপূরক। মেকআপের পর ত্বকের প্রয়োজনীয় যত্নের জন্য আছে ওষুধ কোম্পানির মেকআপ রিমুভার।
কোন সমস্যায় কার্যকর
অ্যাকনে, ব্রণ, সূর্যরশ্মির কারণে ত্বক ঝলসে যাওয়ার সমস্যা, সাধারণ ট্যান, বলিরেখা তোলার জন্য এবং এগজ়িমার সমস্যায় এই ধরনের প্রডাক্ট ব্যবহৃত হয়। এগুলিতে অ্যাক্টিভ উপাদান থাকে। যেমন নায়াসিনামাইড, জ়িঙ্ক, স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, প্যান্থেনল, সেরামাইডস, হায়ালুরনিক অ্যাসিড, রেটিনয়েডস। এগুলির সূক্ষ্ম কণা ত্বকের অনেক গভীরে পৌঁছয় ও ভিতর থেকে ত্বককে সুস্থ ও প্রাণবন্ত করে তোলে। এতে তিনটি উদ্দেশ্য পূরণ হয়— ত্বকের সমস্যার নিরসন হয়, কোষ সুরক্ষিত থাকে, পুষ্টির মাধ্যমে ত্বকের চেকনাই ফিরে আসে। এতে কিছু বিশেষ উপাদান থাকে যা ত্বকের জ্বালাপোড়া, শুষ্কতা দূর করে, লাল ভাব কমায়। ত্বকে দূষণের প্রভাব, বয়সের ছাপ পড়ার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ত্বকের আর্দ্রতা ও প্রাচীরকে রক্ষা করে। সব মিলিয়ে জেল্লা হয় নিখুঁত।
ডা. ধর বললেন, সংবেদনশীল ত্বক তো বটেই, যে কোনও ধরনের ত্বকেই এই ধরনের স্কিনকেয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত। এর তেমন বিজ্ঞাপন হয়তো চোখে পড়ে না। পছন্দের তারকাকে এই সব পণ্যের প্রচারেও হয়তো দেখা যায় না। কিন্তু ওই প্রিয় তারকার মতো ত্বক বা চুল পেতে এই ধরনের প্রডাক্টের উপরে ভরসা করা যায়।
চিরশ্রী মজুমদার
ছবি: অমিত দাস; মডেল: ঋত্বিকা গুহ; মেকআপ ও হেয়ার: সোহরাব আলি; স্টাইলিং: প্রিয়ঙ্কা পরিদা ও শ্রেষ্ঠা রায়; জুয়েলারি: করিশ্মাজ়; লোকেশন: অঞ্জলি কুঞ্জ (বারুইপুর); ফুড পার্টনার: চাওম্যান
আয়ুর্বেদের দেখানো পথে
রূপ হবে নির্মল, ব্রণ-মেচেতার দাগ, এজ স্পট, রোদে পোড়া ভাব— কিছু থাকবে না। আজকের প্রজন্মের লক্ষ্য সেটাই। এখন সৌন্দর্য শিল্প যে কোনও প্রডাক্টকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে। অর্থাৎ একটি বিশেষ কাজ করলেই চলবে না, তাকে অলরাউন্ড দক্ষতা দেখাতে হবে। তাই ঝোঁক এখন এমন প্রসাধনীর দিকে যা অনেক রকম কাজে লাগে, ত্বকের ক্ষতি করে না, পরিবেশবান্ধব। তাই ওয়েলনেস রেঞ্জেও এমন প্রডাক্টের চল হয়েছে যা ত্বকের মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য রক্ষা করে।
এই ডার্মোকসমেটিকসের ধারণাটা নতুন। এ ক্ষেত্রে ত্বকের কোনও বিশেষ সমস্যাকে নির্মূল করা হয়। প্রসাধনীর চেয়ে ওষুধের গুণই বেশি। তবে চেহারার সৌন্দর্য ধরে রাখতেও সাহায্য করে। এতে অ্যাক্টিভ উপাদান থাকে। তাই দিনের শেষে এগুলি সবই রাসায়নিক। প্রাকৃতিক উপায়ে সৌন্দর্য ও চিকিৎসাকে মিলিয়ে কিন্তু পথটা প্রথম দেখিয়েছিল আয়ুর্বেদই। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রেও তার কোনও কুফল নেই। ডার্মোকসমেটিকস এখন মানুষের খুব পছন্দ। তবে এর মূল নীতিগুলি কিন্তু বহু যুগ ধরেই আয়ুর্বেদের মধ্যে দেখা গিয়েছে। তা হল, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যতিরেকে রূপ-যৌবনের দেখভাল।
রূপবিশেষজ্ঞ শেহনাজ় হুসেন