ইউনিসেফ-এর একটি সমীক্ষায় প্রকাশিত যে, ভারতে প্রতি বছর ১৫ লক্ষ নাবালিকার (বয়স যাদের ১৮ বছরের কম) বিয়ে হয়ে যায় এবং ১৫-১৯ বছরের মেয়েদের মধ্যে ১৬ শতাংশ মেয়েরাই বিবাহিত। বয়সের গণ্ডি কিছুটা বাড়ার ফলে উনিশ শতকের শিশু/বাল্যবিবাহ (চাইল্ড ম্যারেজ) বর্তমানে তাড়াতাড়ি বিবাহে (আর্লি ম্যারেজ) পরিণত হলেও আইন-নির্দিষ্ট বয়সের আগেই বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এখনও সমাজে অত্যন্ত প্রবল। রাষ্ট্র ও বিবাহ সংক্রান্ত আইনের একটি ধারাবাহিক ক্রমবিবর্তন এই গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য।
নারীবাদী ইতিহাস চর্চার অন্যতম একটি বিষয় হল বিবাহ ও বিবাহের বয়স। উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে ছিল বাল্যবিবাহ। বালিকা বধূর স্বামীর চিতায় সহমরণ (সতীদাহ নিবারণ আইন, ১৮২৯), বালিকা বধূর পুনর্বিবাহ (বিধবাবিবাহ আইন, ১৮৫৬) এবং সর্বোপরি নাবালিকার সঙ্গে সহবাস (সহবাস সম্মতি আইন, ১৮৯১) কেন্দ্র করে এই সমাজ সংস্কার আবর্তিত হয়। উনিশ শতকের আর একটি সংস্কার অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য, তা হল ১৮৭২ সালের তিন আইন যা ‘স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। যদিও এই আইন শুধু ব্রাহ্মদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তথাপি বিবাহকে এই প্রথম একটি সামাজিক চুক্তি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স বেড়ে দাঁড়ায় ১৪, ছেলেদের ১৮।
বিশ শতকে যে দ্বিতীয় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়, তার অন্যতম উৎস ছিল ‘এজ অব কনসেন্ট’ কমিটি ও ১৯২৯-এর সারদা আইন, যা ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেন্ট অ্যাক্ট’ নামে প্রসিদ্ধ হয়। এই আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১২ থেকে বেড়ে ১৪ ও ছেলেদের ১৮ নির্ধারিত হয়। এই আইনটি সকল ভারতবাসীর জন্যই প্রযোজ্য ছিল, যদিও তার প্রয়োগ নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
মেয়েদের বিয়ের বয়স সংক্রান্ত আইন নিয়ে আলোচনার পূর্বে ঔপনিবেশিক ভারতে ‘নারী প্রশ্ন’-এর স্বরূপ উদ্ঘাটন অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করে লেখিকা প্রথম অধ্যায়ে এই পর্বটি নিয়েই আলোচনা করেছেন। ১৮২৯-এর সতীদাহ, ১৮৫৬-র বিধবাবিবাহ ও নাবালিকার বিবাহের সমস্যা সংক্রান্ত যাবতীয় গবেষণা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই অধ্যায়টি সাজিয়েছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অন্দর/বাহিরের দ্বন্দ্ব থেকে তনিকা সরকারের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের উত্থানের কাহিনি ও আরও কিছু গবেষণাগ্রন্থ থেকে তথ্য চয়ন করেছেন। বিবাহ নিয়ে আলোচনার পরিসরটি মূলত বাংলাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এবং সেখানে জাতপাতের প্রশ্ন ততটা গুরুত্ব পায়নি বলে লেখক মন্তব্য করেছেন। উনিশ শতকের বাংলায় ‘কাস্ট কোয়েশ্চেন’ বা জাতপাতের প্রশ্ন যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তা বর্তমান গবেষণায় স্বীকৃত।
সতী নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে প্রথম অধ্যায়ে। কী ভাবে সতী উনিশ শতকে ‘নারী প্রশ্ন’ হয়ে উঠেছিল; যদিও বিধবার প্রকৃত অবস্থার উন্নতির কোনও প্রচেষ্টা এর অন্তর্গত ছিল না। ব্রিটিশ সরকার শাস্ত্রের অনুশাসনকে মান্যতা দিত বলে সংস্কারকদেরও সেই অস্ত্র ব্যবহার করতে হত। এই প্রসঙ্গেই লতা মনির সেই বিখ্যাত উক্তি, উনিশ শতকের সংস্কার প্রক্রিয়ায় মেয়েদের সক্রিয়তা গ্রাহ্য হয়নি। বালবিধবাদের দুর্দশা মোচনের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগরমশাই বিধবাবিবাহের উদ্যোগ করেছিলেন এবং শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করেই যে বিধবার সমস্যার সমাধান হবে না, সংস্কারকরা সেটাও জানতেন। সমাজকেও তা সাদরে গ্রহণ করতে হবে। লুসি ক্যারল দেখিয়েছেন, বিধবাবিবাহ আইন কী ভাবে হিন্দু বিধবার সম্পত্তির অধিকারকে খর্ব করে।
মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর প্রচেষ্টা উনিশ শতকে সে ভাবে কার্যকর হয়নি, বিশেষত ‘সহবাস সম্মতি আইন ১৮৯১’ প্রণীত হওয়ার পর প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে। বিশ শতকে তা আবার পুনর্বিবেচিত হয়, যার উল্লেখ আছে এই অধ্যায়ে। কিন্তু উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধে সারদা আইন প্রবর্তনের মধ্যের সময়টা ‘স্টেট’ বা রাষ্ট্রের ভূমিকার কী পরিবর্তন ঘটল, তা স্পষ্ট হল না এই অধ্যায়ে।
১৮২৮-এর ব্রাহ্ম সভা থেকে ১৮৪৩-এর ব্রাহ্ম সমাজে উত্তরণের বিবরণ দিয়ে শুরু দ্বিতীয় অধ্যায়। ১৮৭২ সালে পাশ হয় ‘ব্রাহ্ম বিবাহ আইন’, যা তিন আইন নামে সেই সময় পরিচিত ছিল। এই প্রথম বিয়ের বয়স নির্ধারিত হল, অসবর্ণ বিবাহ স্বীকৃত হল এবং পাত্র-পাত্রীর সম্মতি গুরুত্ব পেল। এই বিবাহ আইন ধাক্কা খায় যখন কেশবচন্দ্র সেন নিজের কন্যার বিবাহ দেন নির্ধারিত বয়সের আগেই, যা ব্রাহ্ম সমাজে ভাঙনের সূচনা করে। এই বিবাহ আইনে অনুষ্ঠিত বেশ কিছু বিবাহের বর্ণনা পাই এই অধ্যায়ে।
তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত আছে সহবাস সম্মতি আইন (১৮৯১)— যেখানে সহবাসের বয়স ১০ থেকে বেড়ে ১২ নির্ধারিত হয়— এবং এই প্রসঙ্গে মহারাষ্ট্রের রুকমাবাই ও বাংলার ফুলমণি দাসীর ঘটনা। বহুলিখিত ও চর্চিত এই ঘটনাগুলির পুনর্নির্মাণ কিছু ঘটেনি, শুধু নানা গবেষকের বক্তব্য ও তথ্য সঙ্কলিত হয়েছে। এই আইনে গর্ভাধান সংস্কারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, এই অজুহাতে কলকাতার রক্ষণশীল সমাজ এর বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠে। এই আইনের সুযোগ নিয়ে বাঙালি মুসলমান মেয়েদের স্বামীর নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টার কিছু অজানা তথ্য এখানে সংযোজিত হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে সারদা আইন। এই আইনটি প্রণয়নের জন্য নবগঠিত সর্বভারতীয় মহিলা সংগঠনগুলির, বিশেষত নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনের ভূমিকা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। এই আইনটি নিয়ে বাংলা তথা সর্বভারতীয় বিতর্ক অনেকটা স্থান দখল করেছে। এই অধ্যায়টি অত্যন্ত অবিন্যস্ত, যেখানে বিষয়ের পুনরাবৃত্তি এবং বিষয় থেকে বিষয়ান্তর ও পুনরায় পূর্বতনে ফিরে আসার প্রবণতা পাঠকের অস্বস্তির সৃষ্টি করতে পারে। চতুর্থ অধ্যায়টি সমকালীন বিবাহ আইন সম্পর্কিত। পূর্বতন অধ্যায়গুলির তুলনায় এই অধ্যায়টি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, ভাষার ক্ষেত্রেও একটু হোঁচট খেতে হয়।
পরিচিত ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার যে অঙ্গীকার ছিল গ্রন্থের সূচনাতে, তা অনেকাংশেই ব্যাহত। বহুচর্চিত বিষয় নিয়ে নতুন গবেষণার একটি চ্যালেঞ্জ থাকে— বিষয়টি কত দূর নতুন ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব তা নিয়ে। এ ক্ষেত্রে নতুন তথ্য কিছু সংযোজিত হলেও তা থেকে নতুন কোনও দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা হল কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
ভাস্বতী চট্টোপাধ্যায়