যে বছর লর্ড কর্নওয়ালিস কলকাতায় গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব নিয়ে এলেন, সেই একই বছরে অর্থাৎ ১৭৮৬ সালে ইস্তানবুল হয়ে কলকাতায় এলেন এক গ্রিক বণিক, দিমিত্রিয়স গালানোস। প্রথম জন ভারতে শাসন ও শোষণের ভিতটি পাকা করেন, দ্বিতীয় জন পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দেন ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য ও ইতিহাস। গালানোস এ দেশে না এলে বা তাঁর কুড়ি খণ্ডে রচিত ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রচনা গ্রিক ভাষায় অনূদিত হয়ে এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকলে মনে হয় বহির্বিশ্বে ভারতবিদ্যার এত সম্প্রসারণ সম্ভব হত না।
দীর্ঘ সাতচল্লিশ বছর ভারতে, মূলত কলকাতা ও বারাণসীতে ভারতীয়দের মতো জীবনযাপন করে, একাগ্রতার সঙ্গে সংস্কৃত ও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা আয়ত্ত করে গালানোস কাশীধামেই প্রয়াত হন। দুঃখের বিষয়, এ দেশে প্রথম গ্রিক ভারতবিদ গালানোসের রচনা পুনর্মুদ্রিত হল না। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশে এই বিস্মৃতপ্রায় বৈদগ্ধের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় যিনি ঘটিয়েছিলেন, তিনিও আজ স্মৃতির অন্তরালে— গৌরাঙ্গ গোপাল সেনগুপ্ত।
২০০১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পাঠক সমাজ ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ একটি পুস্তিকায় গৌরাঙ্গ গোপালের জীবনী ও বিভিন্ন পত্রিকায় মুদ্রিত রচনাগুলি প্রকাশ করে তাঁকে সংবর্ধনা জানালেও, তাঁর ইংরেজি লেখাগুলি সেই বইয়ে বাদ পড়ে। এ ছাড়া আরও বহু বাংলা রচনা সেখানে অনুপস্থিত। সম্প্রতি তাঁর পুত্র বিনায়ক সেনগুপ্তের সম্পাদনায় লেখকের প্রবন্ধ সংগ্রহ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী কালে আরও দু’টি খণ্ড প্রকাশিত হবে বলে জানা গিয়েছে।
গৌরাঙ্গ গোপালের তেইশটি রচনা সম্বলিত এই প্রথম খণ্ডের বৈচিত্রপূর্ণ সূচিপত্র দেখলে তাঁর লেখপড়ার পরিধি অনুমান করা যায়। এক দিকে যেমন ‘ইউরোপে বুদ্ধকথার রূপান্তর’ বা ‘প্রাক্-বৈদিক ও বৈদিক যুগে ভারতের পথ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন, অন্য দিকে ‘ভারতরত্ন পাণ্ডুরঙ্গ বামন কানে’ বা ‘বাঙালি সাংবাদিকের ভারতচিন্তা’ নিয়েও। পড়ে লেখকের প্রগাঢ় জ্ঞানের বিস্তৃতিতে বিস্মিত হতে হয়। ‘ডেভিড হেয়ার জীবনী প্রসঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ’ প্রবন্ধে প্যারীচাঁদ মিত্র প্রণীত হেয়ারের জীবনীর তথ্যগত ত্রুটিগুলির প্রতি যে গভীর অধ্যবসায় নিয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন, তা তাঁর গবেষক মনের পরিচায়ক। কলকাতার পুরনো ডাইরেক্টরি দেখে ডেভিড হেয়ার ও তাঁর ভাই ও উত্তরসূরিরা কে কত দিন কোথায় ছিলেন, তা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন তিনি। হেয়ারের ইংল্যান্ডের বাড়িতে রাজা রামমোহন রায় শেষ জীবনে কী ভাবে কত দিন জোসেফ, জন ও জেনেট হেয়ারের সান্নিধ্যে ছিলেন, তা-ও লেখক ছবির মতো বর্ণনা করেছেন; সংযুক্ত করেছেন প্রামাণ্য তথ্য। এমনকি কলকাতার আরমানি গির্জার ঘড়িটি যে আসলে ডেভিড হেয়ারের অগ্রজ আলেকজ়ান্ডারের কাছ থেকেই কেনা হয়েছিল, তা-ও প্রমাণের চেষ্টা করেছেন লেখক। প্যারীচাঁদও যে কত পরিশ্রম করে এক বন্ধুর মধ্যস্থতায় সুদূর স্কটল্যান্ডের ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের কর্মী জনৈক মিস্টার রাস্টের কাছ থেকে সে যুগে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, তা জানাতে লেখক ভোলেন না।
‘বহির্বঙ্গে বাঙালির সাংবাদিকতা’ রচনায় ভারতে কোন বঙ্গতনয় কবে কোন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা পত্রিকা প্রকাশ করেছেন তার ইতিহাস বিবৃত করেছেন তিনি। লক্ষণীয় প্রবন্ধের শেষ কথা, “ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রবাসী বাঙালির সাংবাদিকতার এই অগ্রণী ভূমিকা পরবর্তী প্রজন্মের সাংবাদিকতার গৌরবময় ভিত্তিভূমি সৃষ্টি করে দিয়েছিল। সে প্রসঙ্গ বারান্তরে।” পরবর্তী রচনার সূত্র ও আগ্রহও তিনি চিহ্নিত করেছেন।
ভারতীয় রেলের এক আঞ্চলিক শাখার প্রচার বিভাগে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেও তাঁর গবেষণা ও লেখনী ছিল চলমান। বিদেশীয় ভারতবিদ্যা পথিক, হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হিন্দু পেট্রিয়ট, চীন-ভারত ও ভারত-চীন পরিব্রাজকবৃন্দ প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে প্রবন্ধগুলি লিখেছিলেন, এই বইটি তারই সঙ্কলন।
১৯৮৭ সালের দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রাক্-বৈদিক ও বৈদিক যুগে ভারতের পথ’ রচনাটি মুগ্ধ করে। লিখছেন, “বর্তমানে সিন্ধু প্রদেশের থানো বুলাখান থেকে ওরাঙ্গি পর্যন্ত যে পথটি বর্তমান সেটি একটি প্রাচীন পথের স্মৃতিবাহী।” করাচি বন্দরের নিকটস্থ ওরাঙ্গির সঙ্গে সৌরাষ্ট্রের সমুদ্রকূলের লোথাল বন্দরনগরীর যোগাযোগ অসম্ভব নয়, তাঁর মত। এ ভাবেই হরপ্পা সভ্যতার যুগে থানো বুলাখানের সঙ্গে লোথাল পর্যন্ত যোগাযোগও অনুমান করছেন। কখনও আর্যদের নিয়ে লিখছেন, “এঁরা যে নতুন নতুন পথ প্রস্তুতিতে মনোযোগী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যের অগ্নির ‘পথিকৃৎ’ অভিধায়।... ঋগ্বেদের কয়েকটি মন্ত্রের মর্মানুবাদ লক্ষণীয়। ‘হে পূষণ আমাদের ভ্রমণের সুবিধা করে দাও’, ‘আমাদের নূতন নূতন গোচারণ ভূমির সন্ধান দাও’।” তবে লেখায় তথ্যসূত্র না থাকায় আগ্রহী পাঠকের অধ্যয়ন সহজ হয় না। রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সম্পর্কও তুলে ধরেছেন গৌরাঙ্গ গোপাল: “১৮৯০-৯১ খৃষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতা বিশ্বের সমসাময়িক কাব্যসাহিত্যে অতুলনীয় এই মত প্রকাশ করিয়া ব্রজেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রবিরোধী সমালোচকমণ্ডলী কর্তৃক নিন্দিত হইয়াছিলেন। বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের যথার্থ মূল্যায়ন রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির প্রায় দুই যুগ পূর্বে একমাত্র ব্রজেন্দ্রনাথের দ্বারাই সম্ভব হইয়াছিল।”
পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনার প্রসাদগুণ প্রশ্নাতীত। তবে বইটিতে মুদ্রণপ্রমাদ না থাকলেও সার্বিক যত্নের অভাব; প্রবন্ধগুলি কালানুক্রমে সজ্জিত নয়। তবুও লেখকের রচনাগুলি একত্রিত করার জন্য সম্পাদক ধন্যবাদার্হ।
লোপামুদ্রা পাল চক্রবর্তী