পাবি রে অমূল্যনিধি...
দশ বছরেরও বেশি আগে, ২০১৪ সালে লোপামুদ্রা মিত্র এবং প্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে দোহার-এর নানা আলোচনা এবং পরিকল্পনার ফলস্বরূপ জন্ম নিয়েছিল ‘সহজ পরব’। সেই অর্থে ‘সহজ পরব’ ১১ বছরে পড়ল। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল, উপমহাদেশের লোকশিল্পের ধারাগুলি উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে তার প্রচার ও প্রসার ঘটানো। এই প্রজন্মের শ্রোতা-দর্শকের মধ্যে নানা লোকশিল্প সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ানো এবং এমন একটি মঞ্চ নির্মাণ করা, যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকশিল্পীদের পাশাপাশি জনপ্রিয় লোকশিল্পীদেরও এক ছাদের নীচে আনা যায়।
সম্প্রতি ভারতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হল ‘সহজ পরব’-এর সপ্তম সংস্করণ। অনুষ্ঠানটির সূচনা করলেন দেবাশিস কুমার। প্রথম অনুষ্ঠান ছিল বাউল-ফকির অঁসম্বল। বাংলা দেশে প্রধানত তিনটি ধর্মসাধনার প্রবহমান ধারার ইতিহাস পাই আমরা। বৈষ্ণব সাধনা, সাহিত্য সাধনা ও বাউল সাধনা। এই তিনটি ধারাই বাংলার লোকসংস্কৃতিকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছে। বাউলদের সঙ্গে শাক্ত সাধকদের মিল এক জায়গায়। তা হল, উভয় সম্প্রদায়ই দেহসাধনার ভিতর দিয়ে প্রকৃত তত্ত্বকথাকে খুঁজে পেতে চায়। বাংলার লোকসঙ্গীতের ভান্ডারে বাউল সাধকদের পরমতম অবদান হল বাউল গান। জেলাভিত্তিক বাউল গানের আঙ্গিক ও সুরের নানা বৈচিত্র ছড়িয়ে আছে সারা বাংলাদেশে। বাউল গানে গায়নকর্তার মনের স্বতঃস্ফূর্ততা, ভাবগভীরতা, কাব্যময়তা, মরমি ভাবনা ও সরসতা গ্রামবাংলার জনপদবাসীর মনে এক তন্ময়তার আবেগ সৃষ্টি করে।
লালন ফকিরের গানে আমরা পাই মানবতা ও আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন বিষয়, যা যুগে যুগে বাংলার বাউল সমাজ-সহ বিভিন্ন মানুষের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। বেশির ভাগই তাঁর গান উপস্থাপন করলেন স্বপন অধিকারী, অর্জুন খ্যাপা, নুর আলম ও আমানত ফকির। প্রত্যেকেই সুগায়ক এবং তাঁদের উপস্থাপনা মনে রাখার মতো। উল্লেখযোগ্য গানগুলি ছিল ‘হরি তোমায় ডাকব, সে সময় কই’, ‘কাম গোপন, প্রেম গোপন/ গোপনে রয়েছেন খোদা, তারে চিননি’, ‘আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি দিবারাতি/ নাই সেখানে মনের মানুষ’, ‘সে যে আমি কথার অর্থভারী/ দেখো আমাতে আর আমি নাই’, ‘রাসন নামে পাল তুলিয়া রে আমরা যাই মদিনাতে/ তোরা আর কে যাবি আমার সাথে’ (সুফি গান), ‘ও সে গভীর জলে যাই গো চলে কিনার দিয়ে’, ‘এ ভব কারাগার করিতে পারাপার/ বিপাকে পড়ে যেন ডোবে না তরী’, ‘সে কি জানতে পায় রসের রসিক না হলে’। প্রতিটি গানই সুগীত এবং আসর জমানো। উপস্থাপনায় আন্তরিকতার ছাপ স্পষ্ট।
বাউল গানের পরবর্তী অনুষ্ঠান ছিল কাওয়ালি। গান পরিবেশন করলেন মধ্যপ্রদেশ থেকে আগত শিল্পী মুনাব্বর মাসুম। আমির খসরু রচিত গানে উপস্থাপিত হল প্রশিক্ষিত কণ্ঠশৈলীর মাধ্যমে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান। শেষ পর্বে ছিল গুজরাতের সিদ্ধি ধামাল ডান্স গ্রুপের অনুষ্ঠান। ইন্দো-আফ্রিকান প্রজাতির এই অনুষ্ঠানে আফ্রিকান সুরের রেশ ও আদিম নৃত্যকলার নিদর্শন ফুটে উঠল ওঁদের পরিবেশনায়। একটি অভিনব উপস্থাপনা। হরিনাম সংকীর্তন দিয়ে ‘সহজ পরব’-এর সপ্তম সিজ়নের পরিসমাপ্তি হল।
এই অনুষ্ঠানের বাতাবরণ ছিল চমৎকার। বিশ্বনাথ দে’র মঞ্চসজ্জা, দীনেশ পোদ্দারের আলোকসম্পাত ও বিদ্যুৎ পাড়ুইয়ের শব্দ প্রক্ষেপণ ছিল উচ্চমানের। প্রত্যেকের সচেষ্ট অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি সাফল্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছিল। পরিশেষে উদ্যোক্তাদের কাছে একটি অনুরোধ, অনুষ্ঠানটি আরও কিছুটা সংক্ষিপ্ত করলে দর্শক-শ্রোতারা পরিপূর্ণ ভাবে এই সুন্দর উপস্থাপনার অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতে পারতেন।
সৌম্যেন সরকার