দিগন্তপ্রসারী প্রতিষ্ঠার শপথে গড়ে উঠেছিল হরাইজ়ন শিল্পীদলটি। সমান্তরাল সীমানায় মিলে যাওয়ার ডাক। দলের বয়স ২২ বছর। অর্ধশতকের পথে যেতে এখনও অনেকটাই বাকি তাঁদের। শুরুর দিকে বেশ কিছু শিল্পী এগিয়ে এলেও, কয়েকজন সরে যান নানা কারণে। তবে মূল প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে থেকে গিয়েছিলেন কয়েকজন, যাঁদের জন্য গ্রুপ স্বচ্ছন্দে এগোতে থাকে পরবর্তী কালে।
অ্যাকাডমি অব ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে সম্প্রতি আয়োজিত এই দলের প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন আটজন শিল্পী। বিভিন্ন দলের শোয়ে প্রায়শই দেখা যায়, প্রদর্শনীর বিশেষ নামকরণ করেন তাঁরা। এতে সামগ্রিক ভাবে সেই প্রদর্শনীর একটি দায়বদ্ধতা তৈরি হয় ঠিকই, আবার কিছু ক্ষেত্রে সেই নামকরণের সার্থকতা বজায় রাখা সম্ভব হয় না। সে দিক থেকে এই প্রদর্শনীটির কোনও নামকরণ করা হয়নি, নাম ছিল ‘বার্ষিক কলা প্রদর্শনী’।
এই প্রদর্শনীতে ঢুকে প্রথমেই যেটি অনুভবে আসে, তা হল শিল্পভাষার নানাবিধ করণ-কৌশল। অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ দিনের বিরামহীন চর্চা। সেই যাত্রার সম্মিলিত ফসল উর্বর হতে বাধ্য। ভাস্কর্যের সূচনা দিয়েই মূল আলোচনায় আসা যাক। শিল্পী চন্দন দাস, ব্রোঞ্জের দু’টি পর্যায়ের ‘জয় ও স্টার্টলড’ গঠনে চমৎকার ব্যালান্স এনেছেন। এমন এক পৃথিবী, যেখানে রাজত্ব করে আনন্দ। সুগঠিত ভঙ্গিমায় নির্ভরহীন যাপনের পরিচয় আমরা আগেও পেয়েছি। শিল্পী চন্দন বরাবরই একজন জনপ্রিয় ভাস্কর।
কালজয়ী সত্যের বিমূর্ত সৌন্দর্যকে ফর্মে ধরেছেন বিশিষ্ট শিল্পী কিরণ কুমার সেন। রূপ-অরূপের নির্জনতায় তাঁর জলরঙের কাজ ‘সং অব সাইলেন্স’। ব্যক্তিগত শোকের ছায়ায় আবৃত শিল্পীর বর্তমান ফর্মে আধ্যাত্মিকতার অভিমুখ লক্ষ করা যায়। একটি নিরিবিলি পরিবেশ, না চাইতেও চাঁদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব দেখা যায়। অলক্ষ্যে মন্দিরের ফর্ম এসেছে। ইন্ডিয়ান ইয়ালো, ভারমিলিয়ন ও বার্ন্ট সায়ানের মোলায়েম সুরধ্বনি ছবিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মৌলিক রূপের উপরে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে শিল্পী দীপক মুখোপাধ্যায়ের কাজের বিষয়। প্রেক্ষাপটের আমন্ত্রণ গ্রাফিক্সের বার্তায়। রঙের জাদুতে সেরিগ্রাফ কৌশলের ‘কম্পোজ়িশন’-এ পরিপ্রেক্ষিত ও ত্রিমাত্রিকতা সৃষ্টি হয় অত্যন্ত আধুনিক টেকনিকে।
সঞ্চিতা সেনগুপ্তের কোলাজধর্মী কাজগুলি মানবিক ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছায়া। অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে চলা। এর শেষ কোথায়? শিল্পীর কাজ দেখে মনে হয়, এখানে নারী যেন অসহায়, আর পুরুষ তার শারীরিক শক্তির দ্বারা সেই অসহায়তার সুযোগ নেয় ও উপভোগ করে। ছবিতে সমস্ত সাদা ভেদ করে ভেসে ওঠে একটি নারীমুখ। চতুর্দিক ছিন্নভিন্ন অবস্থা, প্রতিবাদী আঁচ পাওয়া যায়। কোলাজধর্মী পেস্টিংয়ের উপরে স্প্যাচুলার বোল্ড ধাপ। কোথাও চিরুনির আঁচড়। ইয়ালো আর রেডের অল্প ছোঁয়ায় মূল বক্তব্য প্রকাশ পায়।
‘শক্তিরূপা’ শিরোনামে নারীর লড়াইকে ভূমিজ রঙে আপ্যায়িত করেছেন সংবেদী শিল্পী নির্মলকান্তি চক্রবর্তী। বোর্ডের উপরে কোরা থান পেস্ট করা। ডাস্ট কালারের সঙ্গে আঠা মেশানো ও অ্যাক্রিলিক স্প্রে-র মাধ্যমে সমগ্র সারফেসটি প্রথমে করে নেন শিল্পী। এর পরে ড্রয়িংগুলি ধাপে ধাপে এগোয়। যুদ্ধের অংশীদার হিসেবে ‘শক্তিরূপা’র পরিবারের প্রতিটি বাহন যুক্ত হয়েছে— ময়ূর, পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর, বীণা। ছিটকে ছিটকে পড়েছে অজস্র তরবারি। পুরাণে এ রকম না থাকলেও, কল্পনায় পরিবারের একত্র শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্পী। অবজেক্ট অনুযায়ী পেপারে ড্রয়িং করে কেটে বসিয়েছেন। এতে নতুন ভাবে রিলিফ তৈরি হয়েছে।
গ্রামীণ কল্পনার ভাষার প্রতি শিল্পী প্রদীপ ভৌমিকের এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। লোককথার সঙ্গে প্রকৃতি ও পুরাণের সুরকে বরণ করে নেন তিনি এবং সমসাময়িক আখ্যানের সঙ্গে মিশ্রিত করেন। যেমন তাঁর ‘লুকিং অ্যাট’ কাজটি। গ্রামীণ সততা ও আধুনিকতার সংলাপে তৈরি, ফর্মগুলি ফোক স্টাইলের। টেম্পারার টেক্সচার নিয়ে পুরোটাই কাঁথাভিত্তিক কাজ। ছোটবেলায় দেখা দিদিমার কাঁথা স্টিচের বুনন শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার সূত্র ধরে তিনি পথ খোঁজেন এখনও। শিল্পী জানালেন, হাতে বোনা ওই সব গ্রামীণ নকশাগুলি দেখে তাঁর আর ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে না। বাংলার সম্পদ এতই সমৃদ্ধ!
শিল্পী সরোজ সরকারের ছবিতে ফুটে ওঠে আজকের দিনে বস্তুগত দুনিয়ার সারমর্ম। তাঁর ‘অনামা’ ছবির শিল্প প্রকরণে ছিল ট্রান্সপারেন্ট জলরং। মিশ্রণে আছে ড্রাই পিগমেন্ট, প্যাস্টেল। অনন্তের সন্ধানে ভাবনার প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। যেমন শামুক, যারা উড়তে পারে না, তাদের উড়িয়ে দেওয়া। ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যায় আমাদের ব্যক্তিত্ব, সুপ্ত মনের ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে।
প্রমথেশ চন্দ্রর সাম্প্রতিক কাজ মূলত রেখাভিত্তিক। সেলাই ফোঁড়ের এফেক্টে প্রতি মূহুর্তে জন্ম নেয় দৃশ্যের পর দৃশ্য। রেখার তরঙ্গায়িত ভগ্নাংশ জুড়ে উজ্জীবিত জীবনের টেক্সচার। শিল্পী জানালেন, ছোট থেকেই যে কোনও সারফেসে ফর্ম দেখতে পেতেন তিনি। তাঁর ছবিতে সাদার ব্যবহার দু’ভাবে এসেছে। একটি সলিড পার্ট, আর একটি দূরত্বের। অবচেতন মন এবং রহস্যবাদের গভীর ছায়া মনে করিয়ে দেয় একটি লাইন— ‘আমরা যাইনি ম’রে আজও, তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’।
স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সমকালীন শিল্পীদের নিয়ে যথার্থ একটি সংগঠন তৈরি করেছে হরাইজ়ন। তাঁদের সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতেও সেই সমকালীনতার ছাপ স্পষ্ট।
পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়