শারীরচর্চা বাদ, ডায়েটও দরকার পড়ছে না। কিন্তু ওজন কমছে চটজলদি... জেন জ়ি-র মধ্যে ক্রমশ ইনক্রেটিন থেরাপি নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। বিদেশে সহজলভ্য এই থেরাপি, জনপ্রিয়তার খাতিরে ক্রমশ এ দেশেও উপলব্ধ হচ্ছে এই চিকিৎসা। এতে নিয়ন্ত্রণে আসে টাইপ-টু ডায়াবিটিসও। কিন্তু ডায়াবিটিস, ওবেসিটির মতো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় এই চটজলদি সমাধান কি আদতে শরীরের পক্ষে ভাল?
ইনক্রেটিন থেরাপি করিয়ে ওজন ঝরিয়েছেন বলিউড পরিচালক হনসল মেহতা। দিন কয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে থেরাপির প্রশংসাও করেছেন তিনি। সম্প্রতি চোখে পড়ার মতো ওজন ঝরিয়েছেন করণ জোহর, জুনিয়র এনটিআরও। করণ, এনটিআর ইনক্রেটিন থেরাপি করানোর জল্পনা উড়িয়ে দিলেও, সমাজমাধ্যমে আলোচনা চলছে এই চিকিৎসা নিয়ে।
কী এই থেরাপি?
আমাদের অন্ত্র থেকে নিঃসৃত প্রধান দুই হরমোন— জিএলপি-ওয়ান (গ্লুকাগন লাইক পেপটাইড-ওয়ান) এবং গ্লুকোজ় ডিপেন্ডেন্ট ইনসুলিনোট্রপিক পেপটাইড বা জিআইপি। এই ইনক্রেটিন হরমোনগুলি শরীরের প্রাকৃতিক হরমোন, যার প্রধান কাজ রক্তে গ্লুকোজ়ের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। মূলত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার অন্ত্রে পৌঁছলে সেখান থেকে জিএলপি-ওয়ান ও জিআইপি নিঃসৃত হয়, যা শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী ইনসুলিন এবং গ্লুকাগনের মাত্রা ব্যালান্স করে। ইনক্রেটিন থেরাপি দিয়ে এই হরমোনগুলির নিঃসরণ বাড়ানো যায়।
ব্যবহারের পদ্ধতি
ইঞ্জেকশন, ট্যাবলেট দুই আকারেই নেওয়া যায় এই থেরাপি। ইঞ্জেকশন সপ্তাহে একবার নিতে হয়। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল বলছেন, “অন্ত্র থেকে ইনক্রেটিন হরমোন নিঃসৃত হয়। ফলে ট্যাবলেট সরাসরি পাকস্থলীতে পৌঁছে সম্ভবত ইঞ্জেকশনের তুলনায় দ্রুত কাজ শুরু করতে পারে। নিয়মিত নির্দিষ্ট ডোজ়ের একটি করে ট্যাবলেট নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।” তবে ইঞ্জেকশন বা ট্যাবলেটে কাজ একই হয়।
এই থেরাপির সুবিধে
জিএলপি-ওয়ান লিভারে গ্লুকোজ় উৎপাদন কমায়। ফলে এই থেরাপিতে রক্তে গ্লুকোজ়ের মাত্রা কমে, টাইপ-টু ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে আসে, ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স কমে। হাইপোগ্লাইসেমিয়াও (গ্লুকোজ় কমে যাওয়া) এড়ানো যায়। সঙ্গে এই থেরাপি ওজন কমায়। ডা. মণ্ডল বলছেন, “এ ছাড়াও রক্তচাপ, ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে, হৃদ্রোগ এড়াতেও ইনক্রেটিন থেরাপি খানিকটা সাহায্য করে।”
ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে
- টাইপ-টু ডায়াবেটিক রোগীদের মূল সমস্যা ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স এবং শরীরে তার উৎপাদনে ঘাটতি হওয়া। এতে রক্তে গ্লুকোজ়ের মাত্রা বেড়ে যায়। নিয়মিত ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নেওয়া সমস্যার। ইনক্রেটিন থেরাপি শরীরের স্বাভাবিক ইনসুলিন নিঃসরণ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে রক্তে গ্লুকোজ়ের মাত্রা কমাতে ওষুধ নির্ভরতা কমে।
- পেরিফেরাল আর্টারি ডিজ়িজ়ের চিকিৎসাতেও কাজে দিচ্ছে এই থেরাপি। টাইপ-টু ডায়াবিটিসের কারণে এই রোগে হাতে-পায়ে যথাযথ রক্ত সঞ্চালন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, স্বাভাবিক হাঁটাচলায় সমস্যা দেখা দেয়। প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে এ জাতীয় সমস্যাতেও ইনক্রেটিন থেরাপিতে উপকার মিলছে।
ওজন কমাতে
তবে এ চিকিৎসা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ফিটনেস প্রশিক্ষক অরিজিৎ ঘোষাল। বলছেন, “ইনক্রেটিন থেরাপি ব্রেনকে বোকা বানায়। জিএলপি-ওয়ান হরমোন মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে খিদেকে নিয়ন্ত্রণ করে।” পেট ভরা থাকার অনুভূতি দেয়। সঙ্গে হজমপ্রক্রিয়াকে দীর্ঘ করে খাবার পাকস্থলীতে বেশি সময় ধরে রাখে। ব্যক্তির খাওয়ার ইচ্ছে কমায় এই হরমোন। তা ছাড়া, জিএলপি-ওয়ানের দৌলতে নিয়ন্ত্রিত গ্লুকোজ় লেভেল শরীরে ফ্যাট জমতে দেয় না।
সমস্যা কোথায়?
কিন্তু ওষুধ খেয়ে যদি রোগা হওয়া যেত, তা হলে তো জীবনের অর্ধেক সমস্যারই সমাধান হত। অরিজিতের বক্তব্য, মূলত যাঁরা বেহিসেবি জীবনযাপনে অভ্যস্ত, স্বাস্থ্যকর রুটিনে আসতে চান না... এখন তাঁরাই এই থেরাপির দিকে বেশি ঝুঁকছেন। “এই থেরাপিতে দ্রুত ওজন হয়তো কমবে ঠিকই। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শরীরের ক্ষতিও হবে,” মন্তব্য অরিজিতের।
- এই থেরাপি খাওয়ার ইচ্ছে, পরিমাণ দুই-ই কমায়। ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া হয় না। এতে সঙ্গী হয় দুর্বলতা।
- তা ছাড়া, ইনক্রেটিন থেরাপিতে শুধু ফ্যাট ঝরে, মাসল তৈরি হয় না। ফলে হিপ, অ্যাবস, হাতের ফ্যাট ঝুলে গিয়ে ব্যক্তির চেহারায় অসুস্থার ছাপ ফুটে ওঠে। অরিজিৎ বলছেন, “এটা ওষুধের অপব্যবহার। এই স্কিনি ফ্যাটের সমস্যা দূর করতে প্রায় এক বছর সময় লাগে।”
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে সাবধান
- এই থেরাপির শুরুতে ব্যক্তি ডায়রিয়ায় ভুগতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয়।
- অগ্ন্যাশয়কে উদ্দীপিত করে হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়ানোর ফলে প্যানক্রিয়াস, গলব্লাডার ইত্যাদির সমস্যা হতে পারে।
- হৃৎপিণ্ডের সঙ্কোচন-প্রসারণ অনিয়মিত হয়ে হৃদ্পেশি দুর্বল হতে পারে। হার্টে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ রক্তের সঞ্চালন কমে, কার্ডিয়োমায়োপ্যাথির ঝুঁকি বাড়ে, যে কারণে হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে।
- কিডনির জটিলতা, থাইরয়েডের ভয়ও থাকে।
আগে হাসপাতালে ভর্তি ডায়াবিটিস বা অন্যান্য কো-মর্বিডিটি রয়েছে, এমন রোগীদেরই এই থেরাপি দেওয়া হত। ২০১৭ সালে আমেরিকান ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ছাড়পত্র পাওয়ার পর থেকে এখন খোলা বাজারেও এই ওষুধ সহজলভ্য। ডা. মণ্ডল বলছেন, “ব্যক্তি ও তাঁর সমস্যা বিশেষে এই ওষুধের ডোজ়, নিয়মকানুন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আলাদা হয়, যা না জেনেই বহু মানুষ এই ওষুধ ব্যবহার করছেন। ফলে বিপদ বাড়ছে।” তবে ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিংবা ওজন কমাতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কোনও বিকল্প নেই।
কোয়েনা দাশগুপ্ত
ছবি: চিরঞ্জীব বণিক; মডেল: ডা দীপান্বিতা হাজারি, অভীপ্সা খন্না; মেকআপ: দীপঙ্কর দাস; পোশাক: সন্ধ্যারাগ বুটিক (শাড়ি), ইমেজ অ্যান্ড স্টাইল গড়িয়াহাট (শার্ট); লোকেশন:
অঞ্জলি কুঞ্জ (বারুইপুর)