জীবনের পাঠ
সুনীতা উইলিয়ামস আর ব্যারি বা বুচ উইলমোর মহাকাশে গিয়েছিলেন বোয়িং-এর তৈরি স্টারলাইনার স্পেসক্রাফ্টে চড়ে। সব কিছু পরিকল্পনা মতোই চলছিল। কিন্তু ফেরার ঠিক আগে অপ্রত্যাশিত কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাঁদের ৮ দিনের সফর শেষ হতে লেগে গেল ২৮৬ দিন। তার পর ইলন মাস্কের তৈরি স্পেস এক্স ক্রু ড্রাগনে করে তাঁদের ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু সুনীতা আর ব্যারির কাছে কি বিষয়টা অপ্রত্যাশিত ছিল? একদমই না। তাঁরা ভাল করেই জানতেন মহাকাশ সফরের প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে অনিশ্চয়তা আর বিফলতার ভ্রুকুটি। স্পেসক্রাফ্ট যাত্রা শুরুর মুহূর্ত থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। নাসাও তা জানত। আর, আমরা তা জানলাম এত দিনে।
তবুও তাঁরা পিছপা হননি। কারণ নিজের কাজের প্রতি একাগ্রতা আর পেশাদারিত্ব তাঁদের সাহস জুগিয়েছে। সেলেব্রিটি তকমা পাওয়ার জন্য তাঁরা মহাকাশ সফর করেননি। তাঁরা গিয়েছিলেন বিজ্ঞান গবেষণার স্বার্থে। আর আমরা সহজেই ধৈর্য হারাই যখন ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়ি, কোনও পরীক্ষা কিংবা ইন্টারভিউতে প্রথম বার অসফল হই, সুইগি কিংবা জ়োম্যাটোতে খাবার আসতে ২ মিনিট দেরি হয় কিংবা কোনও নতুন প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর হতে যদি কয়েক দিন মাস সময় লাগে। কিন্তু ওই মহাকাশচারীরা ৮ দিনের জায়গায় আটকে পড়লেন ২৮৬ দিন। পরিস্থিতির কোনও নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে ছিল না। তাই তাঁদের মানিয়ে নিতে হত, ধৈর্য ধরতেই হত, অপেক্ষা করতেই হত। আর চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেও বিশ্বাস রাখতে হত ২৮৬ দিন পরে নিজেদের ঘরে ফেরার।
কিন্তু বর্তমান সমাজজীবনে আমরা যেন সহজেই ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়ছি। সস্তায় কোনও কিছু পাওয়ার লোভে সহনশীলতা হারিয়ে ফেলছি। সাফল্যের ইঁদুর-দৌড়ে প্রথম হওয়ার প্রচেষ্টায় ছেলেমেয়েদের বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি। সাময়িক অসফলতায় দোষারোপে বিদ্ধ করছি পরবর্তী প্রজন্মকে। উন্নতির দোহাই দিয়ে ছেলেমেয়েদের জীবনের প্রেশার কুকারে বন্দি করে দিচ্ছি। পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছি। তাই আজকের পর থেকে জীবনে যখনই কোনও অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে হবে, তখন মনে রাখবেন— আপনি অন্তত মহাশূন্যে আটকে নেই। ৮ দিনের জায়গায় ২৮৬ দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
অনিশ্চয়তা জীবনের অঙ্গ। জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, অনেক পরিকল্পনা পাল্টে যাবে, অনেক বিফলতার মোকাবিলা করতে হবে, সফল হতে সময় লাগতে পারে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু যদি সুনীতা উইলিয়ামস আর ব্যারি উইলমোর ৮ দিনের জায়গায় ২৮৬ দিন মহাকাশে বেঁচে থাকতে পারেন, তা হলে আমরাও নিশ্চয় জীবনের ছোটখাটো বাধা সহজেই সামলে নিতে পারব। উইলিয়ামস আর উইলমোরের লড়াই আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।
দীপঙ্কর মান্না
অসলো সায়েন্স পার্ক, নরওয়ে