কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রতিবাদে এবং ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতিকে রোখার ডাক দিয়ে আরও সরব হল বাম ও কংগ্রেস। কলকাতায় আলাদা ভাবে দু’পক্ষের মিছিল থেকে উঠে এল একই আহ্বান। ধর্মতলা থেকে শুক্রবার শিয়ালদহ পর্যন্ত মিছিল ছিল বামফ্রন্টের ডাকে, যাতে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতোই। এআইসিসি-র কর্মসূচি মেনে প্রদেশ কংগ্রেসের মোমবাতি মিছিল ছিল বিধান ভবন থেকে সিমলা স্ট্রিটে স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি পর্যন্ত।
বামফ্রন্টের মিছিলে ছিলেন সিপিএমের মহম্মদ সেলিম, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, সুজন চক্রবর্তী, আরএসপি-র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, সিপিআইয়ের গৌতম রায়, ফরওয়ার্ড ব্লকের সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সেলিম বলেছেন, ‘‘পহেলগামে সন্ত্রাসবাদীরা ধর্ম পরিচয় জিজ্ঞেস করে পর্যটকদের হত্যা করেছে মানুষকে ভাগ করার জন্য। আর আইটি সেল, সমাজমাধ্যমে সেই একই কাজ করা হচ্ছে। কারও হাতিয়ার ‘বুম’ (বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের মাইক), কারও হাতিয়ার বোমা!’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘নদিয়ার ঝন্টু আলি শেখ প্রাণ দিয়ে বুঝিয়েছেন, লড়াই এককাট্টা হয়েই করতে হয়।’’ একই সুরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারেরও বক্তব্য, ‘‘রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে কিন্তু একই সঙ্গে বিভাজনের প্রচার বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। এখানে আমরা দেখছি, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’দের কুৎসিত আক্রমণ করা হচ্ছে, নজরুল ইসলামকে পর্যন্ত ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। যাঁরা এ সব করছেন, তাঁরা অশান্তি বাধাতে চান। জোর গলায় বলছি ধর্মনিরপেক্ষ, হিম্মত থাকলে আমাদের বার করে দিন!’’
এই পরিস্থিতিতে বসে নেই বিজেপি ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনও। কাশ্মীর ও মুর্শিদাবাদে হিন্দুদের উপরে আক্রমণের প্রতিবাদে এ দিন শিয়ালদহ থেকে মিছিল ছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ডাকে। সেই মিছিল যখন ধর্মতলায় শেষ হয়, সেখানে নিজেদের মিছিলের জন্য জড়ো হয়েছিলেন বাম কর্মী-সমর্থকেরা। পরিষদের মিছিল থেকে বামেদের নিশানা করে স্লোগান শুরু হলে উত্তেজনা তৈরি হয়। পুলিশ দু’পক্ষের মধ্যে ব্যারিকেড করে পরিস্থিতি সামাল দেয়। কাশ্মীর ও মুর্শিদাবাদকে এক বন্ধনীতে রেখে এ দিন সন্ধ্যায় স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি থেকে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় পর্যন্ত বিজেপির যুব মোর্চার মশাল মিছিলে ছিলেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি ইন্দ্রনীল খাঁ, উত্তর কলকাতা সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তমোঘ্ন ঘোষ, বর্ষীয়ান নেতা তাপস রায়, পুর-প্রতিনিধি সজল ঘোষ, বিজয় ওঝা, সমাজমাধ্যম শাখার আহ্বায়ক সপ্তর্ষি চৌধুরী প্রমুখ।
মিছিল থেকে পাকিস্তান-বিরোধী স্লোগান তুলে হিন্দুদের এক
হওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছে। মিছিল শেষে প্রতীকী ‘শহিদ বেদি’ তৈরি করে মালা দেন বিজেপি নেতৃত্ব। তার পরে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে, জুতোর
মালা পরিয়ে পাকিস্তান-বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী তথা ঝাড়খণ্ডের রাঁচীর বিজেপি সাংসদ সঞ্জয় শেঠ এ দিনই গিয়েছিলেন পহেলগামে নিহত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আধিকারিক মণীশরঞ্জন মিশ্রের ঝালদার বাড়িতে। মণীশরঞ্জনের ভাই রাহুলরঞ্জন মন্ত্রীকে বলেছেন, “অনেক হয়েছে। আর অপেক্ষা নয়। জঙ্গিদের দমন করা এখন থেকে শুরু হোক।” কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বলে মন্ত্রী তাঁকে আশ্বাস দেন। মণীশরঞ্জনের স্ত্রীর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ কোনও স্কুলে চাকরির আর্জিও জানিয়েছে পরিবার।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর গিয়েছিলেন পাকিস্তানে আটকে পড়া বিএসএফ জওয়ান পূর্ণমকুমার সাউয়ের বাড়িতে। তাঁর মুক্তির বিষয়ে হস্তক্ষেপ চেয়ে বিরোধী দলনেতা রাহুলকে চিঠি দিয়েছেন শুভঙ্কর, কথা বলেছেন এআইসিসি-র পর্যবেক্ষক এবং জম্মু ও কাশ্মীরে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা গুলাম আহমেদ মীরের সঙ্গেও। আর নদিয়ার চাপড়ায় সমাবেশে গিয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী বলেছেন, ‘‘পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল না, আজও নেই। কিন্তু একটা জাতির উপরে, ধর্মের উপরে দোষ চাপিয়ে আমরা নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারি না। পহেলগামে ২৬ জন পর্যটককে হত্যার পর গোটা কাশ্মীর জুড়ে প্রতিটি মসজিদ থেকে ঘোষণা হল বন্ধ পালন করে প্রতিবাদ করার। আর আমরা যদি এখানে সব কিছু ধর্মের নামে রাঙিয়ে দিয়ে কৃষ্টি, সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিই, তা হলে পাকিস্তানের হাতই শক্ত করা হবে।’’
এরই মধ্যে বেহালা পূর্বের তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক রত্না চট্টোপাধ্যায় পহেলগামে নিহত বিতান অধিকারীর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের ওষুধপত্রের খরচ বাবদ আর্থিক সাহায্যের কথা জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও বিতানের বাবা-মায়ের জন্য সাহায্যের আবেদন করেছেন তিনি। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘সবাই এই জঙ্গি হামলার বিরোধিতা করছে। কঠোর পদক্ষেপ চাইছে। কিন্তু হামলার জবাব যখন পাকিস্তানকে দেওয়ার কথা, তখন বিজেপি দেশের মধ্যেই তা নিয়ে ধর্মীয় বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গী-সাথীরাও পথে নেমে পড়েছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সন্ত্রাসবাদী চিহ্নিত না-করে নির্দিষ্ট ধর্মকে চিহ্নিত করার বিপজ্জনক পথ নিয়েছে বিজেপি। দেশের সীমা রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন বাংলার এক মুসলিম তরুণ। তা নিয়ে বিজেপি নীরব।’’
বোলপুরে একটি কর্মসূচিতে গিয়ে পহেলগামের জঙ্গি হানার নিন্দা করে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুরও বক্তব্য, ‘‘ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদের চাষ শুরু হয়েছে! এই চাষ করে ভারতীয়দের সংস্কৃতি, ঐক্য, মেলবন্ধন ধ্বংস করা যাবে না।’’