লাল টুকটুকে শাড়ি পরে বেরিয়ে এলেন ‘বালিকা বধূ’। একগাল হেসে ফোটোগ্রাফারকে ছবি তোলার অ্যাঙ্গল বুঝিয়ে দিলেন। পোজ় দিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আসছে? সুন্দর লাগছে তো আমাকে?” তার পর সোফায় বসে নিজেই শুরু করলেন, “নাও, শুরু করো। তোমার হাতেরটা অন করো, রেকর্ড করবে তো!” এমন হাসিখুশি, সপ্রতিভ অভিনেত্রী একজনই, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়।
প্র: অনেক বছর বাদে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে...
উ: এত বছর বাদে এসেছি মনে হয়নি। কলকাতা আমার বাপের বাড়ি মনে হয়। (কথা থামিয়ে চিত্রগ্রাহকের দিকে তাকিয়ে) কথার মাঝে ছবি তুলবে না আর। তা হলে কিন্তু জয়া বচ্চন হয়ে যাব একদম।
প্র: জয়া বচ্চনের চেয়ে আপনি তো ভাল, ক’দিন আগে নিজেই বলেছেন...
উ: ভাল তো বটেই। আমরা সবাই ভাল। তোমরা খালি ফটর ফটর ছবি তুলবে আর আমরা সব সময়ে ভাল হয়ে থাকব, তা তো সম্ভব নয়। হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম...
প্র: কলকাতায় এলে...
উ: হ্যাঁ, কলকাতা আমার বাপের বাড়ি। এখানকার মানুষ আমায় সহ্য করেছে, ভালবেসেছে। বম্বে শহরে যাঁরা থাকেন তাঁরা জানেন যে, বম্বে কখনও বাড়ি হতে পারে না। বম্বে অফিস আর কলকাতাটা বাড়ি। এই পার্থক্য ছিল আর এখনও আছে।
প্র: ‘আড়ি’র জন্য রাজি হলেন কেন?
উ: পরিচালক জিৎ (চক্রবর্তী) বম্বেতে গিয়েছিল আমার কাছে। যশ-নুসরতকে তখন চিনতামই না। তার পর আমি অলস মানুষ, কাজ করতে পারি না। কিন্তু গল্পটা শুনে মনে হল, যে রোলটা আমায় দিচ্ছে সেটাই আমি। তাই রাজি হয়ে যাই। কিন্তু যে ফাইন্যান্সার ধরেছিল তখন, সে তো পালিয়ে গেল। তার পর যশ-নুসরত এল। আর ওরা দু’জনেই এত ভাল, কী বলব। ওরা আমাকে জানার চেষ্টা করেনি, বোঝার চেষ্টা করেছে।
প্র: যশ-নুসরতের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
উ: ওরা তো আমার ছেলেমেয়েই। আমি যখন জন্মেছি ওরা তখন কোথায় ছিল? এ দিকে সেটে আমাকে বাচ্চার মতো সামলে রেখেছে। ওদের খুব ভালবাসি, বকুনিও দিই। ওদের ছেলে দেখব বলেছিলাম, তখন ছোটটাকে এনেছিল, দুষ্টুটাকে। তবে যশের বড় ছেলেকে দেখিনি এখনও।
প্র: আর শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা...
উ: এরা তো প্রথমে বুঝতে পারছিল না, বুড়িটাকে ম্যানেজ করবে কী ভাবে। তার পর বকুনি টকুনি দিয়ে আমি একটু সহজ করে দিয়েছি সম্পর্কটা। আমি শুটিংয়ে এসেছিও তো ডাক্তারকে লুকিয়ে। পেসমেকার বসানোর দু’মাসের মধ্যে এখানে এসে শুটিং শুরু করে দিয়েছি। ডাক্তার তিন মাস বিশ্রাম নিতে বলেছিল, শুনিনি (বাচ্চাদের মতো হেসে উঠলেন)।
প্র: বম্বে আর বাংলার মধ্যে কোথায় কাজ করতে বেশি ভাল লাগে?
উ: আমার কাজ করতেই ভাল লাগে না। একঘেয়ে কোনও কিছুই ভাল লাগে না। ‘বালিকা বধূ’ ছেড়ে কত বার পালিয়ে গিয়েছি। ওরা যখন মুখে মেকআপ লেপে, চুল বেঁধে, জামাকাপড় পরিয়ে আমায় তৈরি করছে, তখন মনে হচ্ছে খেলার সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্যস! এটা ভাবলেই আর ভাল লাগত না, পালিয়ে যেতাম। বছরে বড়জোর চারটে করে ছবি করেছি। কোনও রবিবার কাজ করিনি। প্রতি বছর দু’মাস ছুটি নিয়ে বিদেশে ঘুরতে গিয়েছি। জীবনকে উপভোগ করেছি। আমি চারআনা অভিনেত্রী, চারআনা স্ত্রী, চারআনা মা আর চারআনা আমি, এক টাকা। মানে এই সব মিলিয়েই ষোলোআনা মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়।
প্র: আপনি তো খুব স্পষ্টবক্তা। তার জন্য সমস্যায় পড়েননি?
উ: হ্যাঁ। আগে মায়ের কাছে বকুনি খেতাম, এখন মেয়ের কাছে। ‘বালিকা বধূ’র সেটে কত বার তরুণ মজুমদার আমায় কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
প্র: এখন কারও সঙ্গে এমন সম্পর্ক তৈরি হয়?
উ: কেউ কারও হৃদয়ে পৌঁছতেই পারে না এখন। সকলেই শুধু ছুটে যাচ্ছে। একটা ছবিতে এখন সাতটা গান, একটা আইটেম, তা-ও লোকে ভুলে যাচ্ছে। আগে সিনেমায় চারটে গান থাকলে, চারটেই লোকে মনে রেখেছে এখনও।
প্র: কলকাতায় এলে কারও সঙ্গে দেখা করতে যান? আগে তো সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন...
উ: এখন যাই না। তরুণ মজুমদার মারা যাওয়ার পরে যত বক্তব্য বেরিয়েছে, সবই দেখেছি বিরুদ্ধে বেরিয়েছে। আমি বললে সত্যিটা বলব। লোকে মুখে বলে, ‘সত্যমেব জয়তে’, কিন্তু সত্যি হজম করতে পারে না। অত বড় বড় অভিনেত্রী মাইকে উঠে টানা মিথ্যে বলছেন, যেহেতু মানুষটা আর নেই। সেটা আমি পছন্দ করি না। যাঁরা নেই, তাঁদের বিষয়ে পাবলিক কথা বলুক আমি চাই না। কারণ তাঁরা তো আর ফিরে এসে বলতে পারবেন না যে, এটা ঠিক বলছে না। তা হলে তুমি কোন সাহসে তাঁদের নিয়ে কথা বলো? নিজের স্ত্রী, মেয়ে হলেও বলা যায় না। একটা মানুষকে চিনতে একটা জীবন কেটে যায়, তা-ও অনেকে চিনতে পারে না। আমাকে উত্তমকাকুর (কুমার) ব্যাপারেও অনেকে জিজ্ঞেস করেছেন, তখন সুপ্রিয়া দেবী ছিলেন। বেলা মুখোপাধ্যায়ের বিষয়েও প্রশ্ন করতেন অনেকে, যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নেই। কিন্তু আমি বলিনি, কারণ এটা উচিত নয়।
প্র: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর আপনি দু’জনেই তো একই ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত ছিলেন...
উ: আমার শ্বশুর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমার কাছে মা-ও ছিলেন, বাবাও। যে দিন আমার শ্বশুর মারা যান, সে দিন মনে হয়েছিল বম্বে শহরে আমি অনাথ হয়ে গেলাম। আমার তো অনেক ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছে, ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করতাম।
প্র: নায়িকা হওয়ার অনেক আগে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আপনার। কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল বলে আফসোস হয়নি?
উ: বম্বেতে সকলে বলত, ‘আপনার কি জন্মেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে?’ আমি ভাবি, ‘ভাগ্যিস হয়েছিল।’ আমার বর খুব ভাল। বুড়োকে ছেড়ে কোথাও বেশি দিন থাকি না। বড় মেয়েটা চলে যাওয়ার পরে বুড়োর জোর কমে গিয়েছে। মেঘা (ছোট মেয়ে) আমার সঙ্গে চলে এলে, ও একা পড়ে যায়। যশ-নুসরতের ইচ্ছে ছিল আমার জন্মদিনে পার্টি করবে। কিন্তু বুড়োর কাছে চলে যাব। তবে ‘আড়ি’-র মুক্তি জন্মদিনে আমার প্রাপ্তি।
জন্মদিনের আগে নিজের সাক্ষাৎকার দেখার আবদার ছিল প্রতিবেদকের কাছে। তাঁর জন্মদিনেই রইল সেই উপহার।
নবনীতা দত্ত
ছবি: সুদীপ ঘোষ