কাঁটা চচ্চড়ি, কী-ই এমন! পাঁঠা চচ্চড়ি চেখেছেন? বাঁধাকপির মেন ডাঁটা, পাঁঠার বাঁ দিকের পাঁজরের হাড়, ছ’টি কাঁচা লঙ্কা, একটু আদা, হিং…! বেশ রসিয়ে জিভে জল আনা অনাস্বাদিত রান্নার গল্প শুনিয়েছিল ‘গল্প হলেও সত্যি’-র জাদুকর রাঁধুনে ধনঞ্জয়। দই ইলিশ তো সোজা! বাড়ির থুত্থুড়ে বুড়ো কত্তাকে কই পয়োধি খাওয়ানোর আশ্বাস দেয় সে। বাড়ির বৌরা এমন রান্না ‘বাপের জম্মে শুনিনি’ বললেও ধনঞ্জয় তার স্বভাবসিদ্ধ বিনীত ভঙ্গিতে বোঝায়, “না শুনলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই! রান্নাটা একটা শিল্প! সমস্ত শিল্পেরই নতুন নতুন সৃষ্টি হয়, রান্নারই বা হবে না, কেন!”
দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ ইনস্টিটিউট অব ইনফর্মেশন টেকনোলজির বিজ্ঞানী গণেশ বাগলারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বহু দিন বাদে তপন সিংহের সিনেমা মনে পড়ল। গণেশের পরীক্ষাগার কোজ়ি ল্যাবে কম্পিউটারের মগজাস্ত্র বা অ্যালগরিদম এখন আকছার চোখের পলকে আশ্চর্য সব রান্না সৃষ্টি করছে, যার রেসিপি শুনে গল্প না সত্যি ঠাহর করতে তাবড় শেফেরা হিমশিম।
ন’বছর ধরে গণেশের নেতৃত্বে কম্পিউটেশনাল গ্যাস্ট্রোনমি অর্থাৎ বৈদ্যুতিন তথ্যনির্ভর খাদ্য বা স্বাদতত্ত্ব নিয়ে চলছে গবেষণা। নেচার পত্রিকা গোষ্ঠীর এনপিজে সিস্টেমস বায়োলজি অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশনস-সহ একাধিক মর্যাদার জার্নালে তা প্রকাশিত। অনেকেরই আশা, আগামী দিনে স্বাদভুবন বা বলা ভাল মানব সভ্যতার জন্যই তা দিক বদলের দরজা খুলতে পারে।
এ কালে চ্যাটজিপিটি, জেমিনাই, লামা-র মতো এআই বা যন্ত্রমেধার অস্ত্রেও নানা কিসিমের রান্না সম্ভব। কিন্তু কোজ়ি ল্যাবের অনেক রেসিপিই বাস্তবের হেঁশেলে যাচাই করা হচ্ছে। তথ্য ভাঁড়ার সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। বিপুল ডেটা মহাসাগর সেঁচে কোন উপাদানের স্বাদ-অণু কার সঙ্গে রাসায়নিক ভাবে খাপ খাবে বা কোন খাদ্য কার শরীরের কলকব্জায় কী ছাপ ফেলবে তারও খতিয়ান মিলছে। পরিবেশগত সঙ্কটে নাজেহাল এ গ্রহে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কম রেখে সবার
জন্য সুলভ, স্বাদু রেসিপিটিরও
খোঁজ চলছে। কুশলী মেধাবী পাচক, ময়রার মতো ওস্তাদ সৃজনশীল একটি রান্নাপটু অ্যালগরিদম ক্রমে আরও পরিশীলিত করে তোলার সাধনায় বিজ্ঞানীরা এখনও মগ্ন।
অথ রাতাতুই কথা
দেড় দশক আগের অস্কারজয়ী সিনেমার সেই মাস্টার শেফ ইঁদুরটিকে মনে আছে? প্যারিসের রেস্তরাঁয় সদা তিতকুটে এক রাশভারী ফুড ক্রিটিক পর্যন্ত যার রান্না খেয়ে বিবশ হয়েছিল। ইঁদুর শেফ ঘরোয়া ফরাসি তরকারি রাতাতুই রেঁধেছিল। রন্ধনকলা বিষয়ক সেই মজার ছবির প্রেরণাতেই গণেশের কোজ়ি ল্যাবের অ্যালগরিদমটির নাম রাতাতুই। ধনঞ্জয় বা ভজহরি মান্নার মতো রাতাতুইও দেশ, বিদেশের রান্নায় সড়গড়। সংগৃহীত লক্ষাধিক রেসিপির ডেটাব্যাঙ্ক (ডিবি) বিশ্লেষণ করে ভারতীয় উপমহাদেশীয়, তাই, ভূমধ্যসাগরীয়, ফরাসি, ইটালিয়ান ২৬ রকম রান্না ঘরানায় নতুন আইটেমের তুকতাক সে বলে দিতে পারে। পছন্দের রান্নাশৈলী এবং উপকরণটুকু বললেই কয়েক সেকেন্ডে মাপজোখ করে রান্নাপ্রণালীটি হাজির করবে। ৭৪টি দেশের এক লক্ষ ১৮ হাজার প্রণালী নিয়ে রাতাতুইয়ের রেসিপি ডিবির পথচলা শুরু। এখন কোজ়ি ল্যাবে প্রায় ছ’লক্ষ রেসিপি মজুত। এই সমৃদ্ধ ভাঁড়ারের সঙ্গে রোবোটিক্সের কৃৎকৌশলও মেলাচ্ছেন গণেশরা।
স্বাদ রহস্য বড়ই জটিল
স্বাদ ভুবন নিখাদ নোলাবাজি নয়। এক-একটি পদের সঙ্গে রান্না-প্রণালীর সাংস্কৃতিক নির্মাণ, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, কার্বন নিঃসরণ মাত্রা সব জড়িয়ে। গণেশ বলছিলেন, “২০৫০ সালে পৃথিবীর ১০০০ কোটি জনসংখ্যাকে খাওয়ানো সহজ হবে না। এ গ্রহের উষ্ণায়নের ফলে খাদ্য ব্যবস্থা থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস বা কার্বন নিঃসরণ নিয়েও ভাবতে হবে। বিপুল ডেটা ঘেঁটে সেই সমস্যাতেও দিশা খুঁজছি।” তাঁদের ল্যাবে সাসটেনেবল ডিবি বলে একটি তথ্য ভাঁড়ার যে কোনও রান্নার উপাদান ধরে গ্রাম, কেজি, লিটার মেপে কার্বন নিঃসরণ মাত্রা অঙ্ক কষে বলে দিচ্ছে।
৯৩৬টি খাদ্য উপাদানের প্রতিটি স্বাদ-অণুর পূর্ণাঙ্গ রাসায়নিক বিশ্লেষণ গুছিয়ে কোজ়ি ল্যাবের ফ্লেভার ডিবি তথ্য ভাঁড়ারটিও আজ দেশে, বিদেশে প্রশংসিত। এক একটি স্বাদ-অণুর তারতম্য ধরে কোপেনহেগেনে একটি গবেষণাকেন্দ্রে খাবার ও পানীয় মেলানো হচ্ছে। নিউ ইয়র্ক সিটির ডেড র্যাবিট পানশালার মিক্সোলজিস্ট বারটেন্ডারও নতুন ককটেল তৈরির নিরীক্ষায় ফ্লেভার ডিবির কার্যকারিতায় মুগ্ধ। স্পাইস ডিবি, ডায়েট ডিবি নামে আরও দু’টি ডেটাব্যাঙ্কও অজস্র খাদ্য উপাদান কাটাছেঁড়া করে দোষগুণের ফিরিস্তি দিচ্ছে। পুণের সিমবায়োসিস স্কুল অব কালিনারি আর্টসের অধ্যাপক রিজ়ওয়ান ইয়ারগাট্টির মতে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রের আস্বাদিত খাদ্য, পানীয়ের তথ্য কাজে লাগিয়ে ডায়েট ডিবি তার গুণাগুণ বা সে যুগের খাদ্য সংস্কৃতিও বিশ্লেষণ করতে পারে। রেসিপি ডিবি-র সম্ভার ঘেঁটে বিরিয়ানি, পোলাও, পায়েসের বিচিত্র প্রণালী নিয়েও গবেষণা চলছে। উপাদানের রকমফের ঘেঁটে কোন প্রণালী কবেকার আঁচ করা সম্ভব।
মানুষ বনাম মেশিন
রাতাতুইয়ের শেখানো চিকেন মোৎজ়ারেলা রেঁধে ডাকসাইটে শেফ মনজিৎ সিংহ গিল দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন। পুণের সিমবায়োসিসেও রাতাতুইয়ের সৃষ্ট রেসিপিগুলি খাওয়ার উপযোগী কি না নিরীক্ষা চলছে। গণেশের দাবি, “কোজ়ি ল্যাবে এআই-এর শেখানো প্রণালীতে রোবট মারফত শরবত তৈরির চেষ্টাও শুরু হয়েছে। র্যাসবেরি পাই বলে একটি প্রযুক্তি ফ্রিজের ভিতরে রাখা দুধ, ফল, আনাজ, মাংস জরিপ করে রেসিপি-র আইডিয়া ছড়াচ্ছে।” কিন্তু সব কিছু নিখুঁত হতে এখনও কিছুটা দেরি। সিক্স বালিগঞ্জ প্লেস রেস্তরাঁর কর্ণধার, শেফ সুশান্ত সেনগুপ্ত দেখেছেন, ইলিশের ঝোলে ফোড়ন কখন দিতে হবে রাতাতুইয়ের অ্যালগরিদম বুঝতে ভুল করছে। বিরিয়ানি রান্নার দু’একটি ধাপও সে ভুলে যাচ্ছে। আবার দেখা গিয়েছে, ডিম, কাজু বাটা, পোস্ত বাটার ঝাল ঝাল পদ রাঁধতে দিলে রাতাতুই মাখো মাখো কাইয়ের বদলে ডিমের ভর্তা বা ডিমের পেটের মধ্যে পুর ভরে ফেলছে। সেটাও মন্দ হচ্ছে না।
গণেশ বলছিলেন, ‘‘নানা নিরীক্ষায় দেখেছি, রাতাতুইয়ের রেসিপি এখন ৭০ শতাংশ নিখুঁত। অ্যালগরিদমকে আরও বুদ্ধিমান করে তুলতে কম্পিউটারের ভাষা বা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলটি আরও ধারালো করে তোলাই রাস্তা।’’ মাপা সময়ের মধ্যে রান্না, ক্যালরি মেপে ডায়াবেটিক বা হার্টের রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট রান্নাও রাতাতুইকে শেখানো হচ্ছে। তা ছাড়া, বাঙালির চেনা মাছ কিছুটা কম এই ডেটাব্যাঙ্কে। রান্না বা স্বাদ সম্ভারে ভারতের নানা প্রদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কাজটাও চলছে।
ধনঞ্জয়ের কই পয়োধি বা পরশুরামের গল্পের ল্যাংড়া আমের ল্যাংচা রপ্ত করতে রাতাতুইয়ের হয়তো সময় লাগবে। তবে শেফদের অনেকেরই মত, রান্না স্বাদু ও স্বাস্থ্যকর করে তুলতে আগামী দিনে বৈদ্যুতিন তথ্যনির্ভর অ্যালগরিদমই ভরসা। রাতাতুই তখন তপন সিংহের ছবির ধনঞ্জয়ের মতো মুশকিল আসান হয়ে উঠতেই পারে। যা গল্প হলেও সত্যি! জয় যন্ত্রের জয়!
ঋজু বসু