পুলিশের ব্যবহার
কয়েক দিন আগে চুঁচুড়া থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়ে চূড়ান্ত হয়রান হলেন এক মহিলা ও তাঁর নাবালিকা কন্যা। সংবাদে প্রকাশ, সারা রাত থানায় বসিয়ে রেখে তাঁদের অজস্র প্রশ্ন করার পরেও অভিযোগ দায়ের হয়নি, পর দিন পাঠানো হয়েছে মহিলা-থানায়। এ কেবল পুলিশের কর্তব্যে অবহেলা নয়, এই অকারণ নিষ্ঠুরতার শিকড় পুরুষতন্ত্রের নারীবিদ্বেষে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী চোদ্দো বছরের একটি মেয়ে, মেলা দেখে বাড়ি ফেরার সময়ে যার ফোন কেড়ে নেয় দুষ্কৃতীরা। জোর করে বসিয়ে কুপ্রস্তাব দিতে থাকে। এলাকার মানুষের তৎপরতায় এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেয়ে ওই নাবালিকা যখন মায়ের সঙ্গে থানায় আসে, তখন মা ও মেয়ের মানসিক অবস্থা আন্দাজ করা কঠিন নয়। কেন তাঁদের সারা রাত ‘শিশুবান্ধব’ কক্ষে বসিয়ে রেখে প্রশ্ন করা হল? একটি মেয়ের উপর নির্যাতনের জন্য মেয়েটিকেই শাস্তি দেওয়া, এ হল ‘রেপ কালচার’ বা ধর্ষণ সংস্কৃতির প্রথম লক্ষণ। দ্বিতীয় লক্ষণ অভিযুক্তের প্রতি শিথিলতা— মেয়েটির যৌন-হেনস্থায় অভিযুক্ত যুবকদের বিরুদ্ধে, এবং চুঁচুড়া থানায় হয়রানকারী পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তারা কী ব্যবস্থা করেছেন, তা-ও জানানো হয়নি পুলিশের তরফে। ওই নাবালিকার বাবা-মা যে এই পুলিশি দুর্ব্যবহারের পরেও চুঁচুড়া থানার কর্তব্যরত পুলিশদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে সাহস করেননি, তা হুমকি সংস্কৃতির অন্যতম পরিচয়। এই হুমকি সংস্কৃতি, ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই বিপুল জনতা পথে নেমেছিল অভয়া কাণ্ডে। অগণিত নাগরিকের ঐকান্তিক প্রতিবাদেও পুলিশ-প্রশাসন ভয় দেখানোর অভ্যাস থেকে বিন্দুমাত্র সরেনি।
এমন নানা ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে একটি ধারণা দীর্ঘ দিন ধরে পুষ্ট করে চলেছে। তা হল, থানা মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। ১৯৭২ সালে মহারাষ্ট্রের একটি থানায় এক আদিবাসী নাবালিকার ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়েছিল দুই পুলিশকর্মী। সুপ্রিম কোর্ট তাদের নিরপরাধ ঘোষণা করায় সারা দেশে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়, এবং পরবর্তী নানা আন্দোলনের ফলে নানা সংস্কার আনা হয়— ধর্ষণের আইনে সংশোধন, পুলিশের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, মহিলা-থানা প্রবর্তন, বিশেষ আদালত নির্মাণ, প্রভৃতি। কিন্তু সব সংস্কারের মধ্যেই ঢুকে বসে রয়েছে ধর্ষণ-সংস্কৃতির ভূত, বিচারপ্রার্থী মেয়েদের সামনে পেলেই যা দাঁত খিঁচোতে শুরু করে। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অধ্যাপক নির্বিকার জসল দেখিয়েছেন, থানা থেকে আদালত, তদন্ত ও বিচারের প্রতিটি পদক্ষেপে কী ভাবে মহিলা অভিযোগকারীর প্রতি পক্ষপাত করা হয়। মহিলারা পুলিশ চৌকির চৌকাঠ পেরোতেই দ্বিধা করেন। যখন তাঁরা থানায় যান, তখন তাঁদের অভিযোগ দায়ের করার জন্য পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি সময় বসিয়ে রাখা হয়। তবে মহিলা অভিযোগকারীর সঙ্গে যদি কোনও পুরুষ থাকে, তা হলে কাজটা তাড়াতাড়ি হয়। মহিলাদের অভিযোগের তদন্তে বিলম্ব হয় বেশি, শেষ অবধি আদালতে গিয়ে পৌঁছয় আরও কম মামলা। আদালতে মেয়েদের করা মামলা ‘ডিসমিস’ হয় বেশি, অভিযুক্ত নির্দোষ সাব্যস্ত হওয়ার হারও বেশি। কেবল নারী হিংসার অভিযোগই নয়, রাষ্ট্রের কাছে বিচারপ্রার্থী যদি হন মহিলা, তা হলে যে কোনও মামলাতেই অন্যায়কারীর শাস্তি পাওয়ার হার কমে যায়।
খাতায়-কলমে কিছু বিধিনিষেধে এর পরিবর্তন হবে না। মেয়েদের প্রতি থানার দুর্ব্যবহার এড়াতে নানা ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট অনলাইন অভিযোগ দায়ের করার বিষয়ে সরকারের মত জানতে চেয়েছে। রাতে মেয়েদের থানায় তলব না করা, থানায় মহিলা-পুলিশকর্মী রাখা, মহিলা-থানা বাড়ানো, এমন নানা ব্যবস্থা হচ্ছে। এগুলি প্রয়োজন, কিন্তু এ সবই যে মূল সমস্যাটিকে এড়িয়ে যাচ্ছে, তা হল, মেয়েদের প্রতি পুলিশের নির্দয়তা, হিংসা। তার নিদর্শন সামনে এলে তৎক্ষণাৎ তদন্ত করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে দোষীকে।