আপনার নামের মানে কী?
উত্তর পেলাম, ‘আমায় দু’রকম বলা হয়েছিল। এক, যাকে কেউ কখনও ভুলতে পারে না। দুই, যে স্মৃতিধর।’
শুনে মনে হল, স্মৃতি তো কেবল অতীতের সামগ্রী নয়। স্মৃতি রোজ তৈরি হচ্ছে, তা বর্তমানেরও উপাদান। স্মরণজিৎ চক্রবর্তী যেমন প্রতি দিন এক ধরনের স্মৃতি ধরে রাখেন। মোবাইল ফোনে ছবি তোলেন কলকাতার—বিশেষত দক্ষিণের—নিঃসঙ্গ সব সরণির, নিভৃত, আড়ালকামী সব গলির। অথবা পাতা ঝরে যাওয়া গাছের আড়াল থেকে শহুরে আকাশের। হারিয়ে যাওয়া থেকে অন্তত এক জনের তোলা ফোটোগ্রাফে বেঁচে থাকে শহরের শরীর। তাঁর উপন্যাস-গল্পও সাক্ষ্য বহন করে শহরের বিবিধ অধুনালুপ্তদের—কখনও কোনও বিপণি, কখনও কোনও ক্যাফে-রেস্তরাঁ, কখনও কোনও বাড়ি।
যদিও আপাতত, তাঁর নামের প্রথম ব্যাখ্যাটিই সুপ্রযোজ্য। কারণ, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-সম্মান সারণিতে পাকাপাকি ভাবে স্থান করে নিলেন তিনি। দেশ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক ও লেখক হর্ষ দত্ত, অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসক ও সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী, অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার, অধ্যাপক ও চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ-সমালোচক সুশোভন অধিকারী এবং বাংলাদেশের লেখক মোস্তফা কামাল—স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিশিষ্ট এই পাঁচজন বিচারকের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে ১৪৩১ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হচ্ছে স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘শূন্য পথের মল্লিকা’।
অতএব, তাঁকে বিস্মৃত হওয়া এ বার সত্যিই অসম্ভব।
কথাটা শুনে অল্প হাসলেন। স্মরণজিতের বিশেষত্ব, জীবনের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে তিনি নির্লিপ্ত। তাঁর প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট, সে নির্লিপ্তি অন্তত এই মুহূর্তে খানিক পিছু হটেছে—‘আমার জীবনে উচ্ছ্বাস বরাবরই কম। তবে আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার সংবাদ আমায় অসম্ভব বিস্মিত করেছে। আমি পেলাম এই পুরস্কার, এ কথা আমার ভাবতেই আশ্চর্য লাগছে! আমার মা বই পড়তেন, আনন্দ পুরস্কারের খোঁজ খবর রাখতেন। ছোটবেলায় তাঁর কাছেই প্রথম শুনেছিলাম এই পুরস্কারের কথা, পুরস্কার প্রাপকদের কথা। বাংলা সাহিত্যের এক-একজন দিকপাল পেয়েছেন এ পুরস্কার। আর আজ, আমিও পাচ্ছি! এ আমার আশাতীত পাওয়া। আশাতীত পাওয়ার এক স্বতন্ত্র আনন্দ থাকে। আনন্দ পুরস্কার সেই আনন্দ এনে দিয়েছে আমায়। আনন্দবাজার সংস্থা ও আনন্দ পুরস্কার বিচারকমণ্ডলীর কাছে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।’
গত শতকের শেষের দিকে লেখালিখি শুরু স্মরণজিতের। পাঠক সমাদর লাভ করেছেন দ্রুত। পাল্টা হাওয়া যখন দেশ-এ ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে, তখনই বোঝা গিয়েছিল, এই স্বর একদম সতেজ, তারুণ্যদীপ্ত। যে-প্রজন্মের যৌবন তখন মিশে যাচ্ছে বিশ্বায়নের অভিনব এক ভাষার সঙ্গে, যে-প্রজন্ম তখন আন্তর্জাতিক জীবনচর্যার সঙ্গে, যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে, খাদ্যাভাসের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে নিতে শিখছে, স্মরণজিতের শব্দরা তাদের কাহিনিই বলতে শুরু করেছে। ক্রমশ, একুশ শতকীয় বাঙালি জীবনের বা আরও-একটু নির্দিষ্ট করে বললে, একুশ শতকীয় বাঙালি যৌবনের অদ্বিতীয় ধারাভাষ্য হয়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্য। এখানেই স্মরণজিৎ অনন্য।
আইডিয়া না ঘটনা, শূন্য পথের মল্লিকা-র উৎসমুখ কোনটা? ‘দুটোই’, বললেন স্মরণজিৎ, ‘এ উপন্যাস লেখা হয়েছিল কোভিডের সময়। লকডাউন তখন কিছুটা উঠেছে, কিছুটা ওঠেনি। ফার্স্ট ওয়েভ শেষ হয়েছে, সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হচ্ছে। কোভিড, লকডাউন, মানুষের অনিশ্চিত জীবন, অকস্মাৎ পাল্টে যাওয়া জীবন—এ সবের ভিতর দিয়ে যেতে-যেতে আমার মনে হচ্ছিল এমন একটি কাহিনি লিখব যার সমাপ্তি ঘটবে বিশ্বজোড়া লকডাউন ঘোষণার সময়।’
অর্থাৎ, শেষ থেকে শুরু। ‘হ্যাঁ। এবং আমি এ উপন্যাস আমার অন্য উপন্যাসের মতো সোজাসুজি ভাবে লিখতেও পারিনি। শূন্য পথের মল্লিকা-র চারটি ভাগ। আমি প্রথমে লিখতে শুরু করেছিলাম যা এখন তৃতীয় ভাগ। লিখতে-লিখতে মনে হল, এর একটা আগের পর্ব থাকলে ভাল হয়। লিখলাম। সেটা লিখতে গিয়ে মনে হল, তারও আগে একটা পর্ব দরকার। তাও লিখলাম। এরপর ফের তৃতীয় পর্বে ঢুকে, প্রথম দুই পর্বের সঙ্গে সেটাকে মিলিয়ে লিখলাম। শেষে, একটা কনক্লুডিং এপিসোডও দিলাম।’
এ যে গোদারের সেই বহু-উদ্ধৃত আপ্তবাক্যের অলঙ্করণ—প্রত্যেক কাহিনির শুরু, মাঝখান আর শেষ আছে, তবে তা যে সবসময় সেই ক্রমই মেনে চলে, এমনটা নয়! ‘ঠিকই’, বললেন স্মরণজিৎ, ‘আর শুধু তা-ই নয়। লেখার সময় আমি ভেবেছি গ্রিক ট্র্যাজেডির কথাও। হামার্তিয়া—যেখানে এক জনের অবুঝ আচরণ নিয়তি নিয়ন্ত্রিত হয়ে কী ভাবে তারই পতনের কারণ হয়ে ওঠে। হিউব্রিস—অতি মাত্রার আত্মবিশ্বাস, যা চরম পরিণতি ডেকে আনে। মনে হয়েছে ডমিনো ইফেক্টের কথাও—এক প্রজন্মের ভুল কী ভাবে অভিঘাত সৃষ্টি করতে-করতে যায় পরবর্তী প্রজন্মে।’
স্মরণজিতের পাঠক মাত্রই জানেন, তাঁর উপন্যাস সাধারণত এক ভাললাগার অনুভবে, সুখানুভূতিতে সমাপ্ত হয়। কিন্তু তাঁর নিজেরই স্বীকারোক্তি, শূন্য পথের মল্লিকা এক ব্যতিক্রম। ইচ্ছে করেই এখানে এক অনিশ্চয়তা রেখে শেষ করেছেন। অনিশ্চয়তা জীবনের অঙ্গ, এ কথা মানতে দ্বিধা থাকা উচিত নয় কারওরই। স্মরণজিতের সাহিত্যভুবনে শূন্য পথের মল্লিকা সে বার্তা বহন করেও ব্যতিক্রমী।
উপন্যাসের একটি চরিত্র রাজু বলে, ‘মানুষের মতো এত ফ্লেক্সিবল প্রাণী আর কেউ নেই!...ভোটের আগে নেতারা আর তাদের ভাড়া করা দালালরা আমাদের কী বোঝায়? বোঝায় যে, মানুষের হাতেই সব ক্ষমতা। কিন্তু আসলে কি তাই?’ দুর্নীতিরাজের এ জমানায় রাজুর প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে, তা নিয়ে কোনও সংশয় থাকতে পারে না।
কী মনে হয় আপনার আশপাশের দুর্নীতি দেখেশুনে? ঈষৎ নীরব থেকে স্মরণজিৎ বললেন, ‘সাংঘাতিক হতাশাজনক। আমি আশা দেখি না কোনও। বিয়ন্ড রিডেম্পশন! এখনও যাঁরা স্তাবকতা করে যাচ্ছেন, তাঁরা এক-একজন বড় বড় গর্ত খুঁড়ে যাচ্ছেন, আগামী প্রজন্ম সেই অন্ধকার গর্তে পড়বে।’
হতাশা সর্বাত্মক হলেও লেখায় থাকে অনন্ত আশা। স্মরণজিতের সাহিত্যজীবনেও সম্পূর্ণ হল এক বৃত্ত—পাল্টা হাওয়া-য় যার সূচনা, পাল্টানো সময়ের আখ্যান শূন্য পথের মল্লিকা-য় তার পূর্ণতা স্পর্শ। স্মরণজিৎ জানাচ্ছেন, তিনি সতর্ক, ‘আনন্দ’-প্রাপ্তি তাঁর ‘গার্ডস’ ঠিক করে নেওয়ার সময়। ব্যাটিং আরও বাকি।