ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন হিরণ্ময় রায়চৌধুরী। তার পর তপতী তাঁকে চা-বিস্কুট দিয়ে যায়। খাটে বসেই তিনি চা-বিস্কুট খান। এর ঘণ্টাখানেক পরে ছানা নিয়ে আসে তপতী। তত ক্ষণে খবরের কাগজও চলে আসে। ছানা খেয়ে কাগজ পড়েন হিরণ্ময়বাবু।
কাগজ পড়া হলে দ্বিতীয় রাউন্ড চায়ের অর্ডার দেন। এখন শীতকাল। চা-টা একটু বেশি হয়ে যায়।
তপতী সারা দিনের কাজের মেয়ে। পাশাপাশি হিরণ্ময়বাবুর দেখাশোনাও করে। তিনি হাঁটতে পারেন না। হুইলচেয়ারই তাঁর অবলম্বন। তাঁর দুটো পা আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত। হাঁটতে পারেন না। অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন। প্রচুর ওষুধ খেয়েছেন। লাভ হয়নি। তবে ডাক্তাররা বলেন, একেবারে হাঁটতে না পারার বিষয়টা কিছুটা তাঁর মানসিক কারণেও বটে। সারা দিন একাকিত্বের যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে হিরণ্ময়ের মৃত্যুচিন্তা আসে মাঝে মাঝেই। মনে জোর পান না, কিছু ভালও লাগে না।
স্ত্রী-বিয়োগের পর থেকে নিঃসঙ্গতা তাঁকে ঘিরে ধরেছে। একমাত্র সন্তান দেবজিৎ, হাওড়ার বাগনানের একটি হাই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। বিয়ে করেছে ওই স্কুলেরই বাংলার শিক্ষিকা শ্রীতমাকে। শ্যামবাজার থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি কষ্টকর। তাই তারা বাগনানেই একটা দু’কামরার ছোট ফ্ল্যাট কিনেছে। শনিবার বাড়ি আসে। পরদিন চলে যায়। কোনও কোনও সপ্তাহে আসেও না।
হিরণ্ময়বাবু ভাবেন, বাড়িতে যদি একটা নাতি কি নাতনি থাকত, কত ভাল হত তা হলে! ছোট ছোট পায়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়াত। তাঁকে দাদু-দাদু করত, কোলে উঠে বসত। তিনি নানা গল্প শোনাতেন। অবশ্য ছেলে-বৌমা কি তাকে রাখত এখানে! আর সত্যিই তো, এখানে কে-ই বা দেখাশোনা করবে তার!
পুজোর ছুটিতে টানা দশ দিন ছিল দেবজিৎ আর শ্রীতমা। এই ক’টা দিন তিনি যেন নতুন জীবন পেয়েছিলেন। ছেলে-বৌমার সঙ্গে গল্প, হাসি-ঠাট্টা করেই কেটে গিয়েছিল দিনগুলো। কিন্তু তারা চলে যাওয়ার পর আবার সেই একাকিত্বের যন্ত্রণা।
সে বার শ্রীতমা বলেছিল, “বাবা, মনে নেই, অর্থোপেডিক সার্জেন কী বলেছিলেন? আপনার হাঁটাচলা করার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। মাঝে মাঝে হাঁটার চেষ্টা করে দেখতে তো পারেন! অন্তত আমরা যখন থাকি, আমাদের ধরে-ধরে...”
শ্রীতমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হিরণ্ময়বাবু বললেন, “কোনও দরকার নেই। আমি এ ভাবেই থাকব। বরঞ্চ তোমরা চেষ্টা করো তাড়াতাড়ি বদলি হয়ে এখানকার কোনও স্কুলে চলে আসার।”
“বদলি কি মুখের কথা বাবা! চেষ্টা তো করছি। সরকারি ব্যাপার, জানোই তো...” দেবজিৎ বলল।
হিরণ্ময়বাবু বললেন, “বেশ, তোরা পাকাপাকি এখানে চলে আয়, তার পর হাঁটার চেষ্টা করব।”
“এটা তোমার রাগের কথা বাবা। সেরে ওঠার কোনও চেষ্টাই নেই তোমার। মনে নেই ডক্টর কী বলেছিলেন, শুধু ওষুধ খেলেই হবে না। ভাল হয়ে ওঠার পজ়িটিভ ভাবনাটাও দরকার।”
“ঠিক আছে, পজ়িটিভ ভাবার চেষ্টা করব। এখন বৌমা, এক কাপ চা করো তো। লিকার চা। একটু পাতিলেবুর রস আর বিটনুন দিয়ো।”
শ্রীতমা উঠে যেতেই দেবজিৎকে বললেন, “তোদের বিয়ে হয়েছে আড়াই বছর হল। এ বার তো নাতি-নাতনির মুখ দেখার কথা আমার।”
দেবজিৎ একটু ক্ষণ চুপ করে রইল। তার পর বলল, “আসলে আমরা এখনই বাচ্চা চাইছি না।” সে বাবার কাছ থেকে উঠে জানলার সামনে গেল। বোঝা গেল, এ বিষয়ে আর কথা বলার ইচ্ছে নেই তার।
হিরণ্ময়বাবু সব বোঝেন। এখন ছেলেমেয়েরা অনেক হিসেব-নিকেশ করে বাচ্চা নেয়। বিশেষত যেখানে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করে। কিন্তু তারা খেয়াল করে না, সব কিছুরই একটা সময় থাকে। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর বাচ্চা হলে সমস্যা বাড়ে। হতাশা বাড়ে হিরণ্ময়বাবুর। ছেলে-বৌমা এখনও বাচ্চা চাইছে না, তা হলে কখন চাইবে! বেঁচে থাকতে কি আর নাতি-নাতনির মুখ দেখার ভাগ্য হবে তাঁর!
বিকেল পড়ে এসেছে। শীতকালে ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে। জানলা দিয়ে হিমেল হাওয়া আসছে ঘরে। জানলাটা বন্ধ করে দিল দেবজিৎ।
*****
সকাল দশটার মধ্যে হিরণ্ময়বাবুকে চান করিয়ে, খাইয়ে, হুইলচেয়ারে বসিয়ে বাড়ির সামনের চিলড্রেন’স পার্কে নিয়ে আসে তপতী। পার্কের এক পাশে হুইলচেয়ার রেখে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হুইলচেয়ারে বসে থাকেন হিরণ্ময়বাবু। সারা শরীরে রোদ লাগে। এটা খুব আরামের সময় তাঁর। মাঠে বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো ছোটাছুটি করে, খেলে। রঙিন প্রজাপতির মতো দেখায় তাদের। তিনি একমনে সেই খেলা দেখেন। ঘণ্টাদুয়েক পর তপতী আবার বাড়ি ফিরিয়ে আনে তাঁকে।
একটা সময় বাড়ি ফিরতেই হয়। আবার সেই নিঃসঙ্গতা। নৈঃশব্দ্য। আজকাল টিভি দেখতেও আর ভাল লাগে না। এই বয়সটা অনেক মানুষই ঠাকুর-দেবতা, পুজোআচ্চা নিয়ে থাকেন। কিন্তু তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। এক সময় কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। তরুণ বয়সে বার দুই জেলও খেটেছেন। এখন আর কোনও স্বপ্নের কাজল নেই তাঁর চোখে। এখন শুধু দিন গোনার পালা। এ ভাবে দিনের পর দিন পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকা যে কী যন্ত্রণার...
বাবার সঙ্গে একটা দিন কাটিয়ে দেবজিৎরা চলে গেল। আগামী সপ্তাহে তারা আর আসতে পারবে না। দেবজিতের সহকর্মীর বিয়ে। সেখানে থাকতে হবে। শুনে, হিরণ্ময়বাবু বললেন, “তার পরের সপ্তাহে আসছ তো?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই আসব বাবা। তুমি সাবধানে থাকবে। এ বছর ঠান্ডাটা খুব বেশি পড়েছে। রুম হিটার জ্বালাবে। আর তপতীকে বলবে, তুমি শুতে যাওয়ার আগে যেন রুম হিটার বন্ধ করে দেয়।”
সত্যিই কি ছেলে তাঁকে ভালবাসে, নাকি এ সবই অভিনয়, বুঝতে পারেন না হিরণ্ময়বাবু।
আজ কুয়াশা পড়েছে খুব। রোদ উঠতে উঠতে বেলা গড়িয়ে গেল। তপতী বলল, “সকালে তো হল না। আজ দুপুরে পার্কে যাব দাদু। রোদটা উঠুক।”
হিরণ্ময়বাবু বললেন, “সে আজ না হয় না-ই গেলাম পার্কে।”
“না গো দাদু। তোমার পায়ে রোদ লাগানো দরকার। না হলে ব্যথা বাড়বে আবার।”
মেয়ের খুব চিন্তা তার দাদুর জন্য! তিনি মারা গেলে এই মোটা মাইনের কাজটা চলে যাবে বলেই কি এত চিন্তা তাঁকে নিয়ে! এই প্রজন্মের কাউকেই তিনি আর বিশ্বাস করতে পারেন না।
দুপুরে হুইলচেয়ার ঠেলে হিরণ্ময়বাবুকে পার্কে নিয়ে গেল তপতী। সারা সকাল কুয়াশার চাদরে চার পাশ মুড়ে থাকার পর চমৎকার রোদ উঠেছে এখন। হিরণ্ময়বাবু তপতীকে বললেন, “এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কী করবি! দুপুরে তো একটু ঘুমোস তুই। বাড়ি যা। রোদ পড়ে গেলে, এসে আমাকে নিয়ে যাস।”
“আমি না থাকলে তুমি আবার হুইলচেয়ার চালিয়ে এ দিক-ও দিক যাবে না তো!” ভ্রু কুঁচকে বলল তপতী।
“আমি হুইলচেয়ার চালাই? তুই-ই তো আমাকে ঠেলে ঠেলে এ ঘর থেকে ও ঘরে নিয়ে যাস। আর আমি পার্কের মধ্যে হুইলচেয়ার চালাব! যা, নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি গিয়ে ঘুমো। সারা দিন অনেক পরিশ্রম গেছে তোর। এখন আর আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।”
তপতী একটু ইতস্তত করে চলে গেল।
পার্কে বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো খেলছে। ছোটাছুটি করছে। দোলনায় দুলছে। তাদের মায়েরাও বসে আছে পার্কের বেঞ্চে। গল্পগুজবে ব্যস্ত তারা। প্রতিদিন পার্কে যখন আসেন, তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে লজেন্স থাকে। তপতীকে দিয়ে আনিয়ে রাখেন তিনি। বাচ্চারা যখন খেলতে খেলতে এ দিকে আসে, তাদের ডেকে লজেন্স দেন। বাচ্চাগুলো তাঁর মুখচেনা হয়ে গিয়েছে।
রোদের তেজ কমে আসছে। একটু পরেই তপতী আসবে তাঁকে নিতে। তার পর আবার সেই চার দেওয়ালে বন্দি।
আজ দু’জন বাচ্চা মেয়েকে দেখলেন হিরণ্ময়বাবু। আগে কখনও দেখেননি এদের। বছর সাত-আট বয়স হবে। হঠাৎই তাঁর দিকে ছুটে আসতে লাগল তারা। হিরণ্ময়বাবুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনে।
বাচ্চা দুটোর মধ্যে এক জন বলে উঠল, “দাদু, তুমি নাকি চকলেট দাও!”
“হ্যাঁ রে। কিন্তু তোদের তো আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না!” বললেন তিনি।
“দেখবে কী করে! আমরা তো গত সপ্তাহে এসেছি। বাবা ওখানে ফ্ল্যাট কিনেছে না!” পার্কের উল্টো দিকে হাত দেখিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল বাচ্চাটি, আজকেই প্রথম এলাম এখানে।
“তোদের কে বলল, আমি চকলেট দিই?”
“আমাদের নতুন ফ্রেন্ড অর্ক, মোনালিসা আর তিতাস— ওরাই বলল। তোমার নাম নাকি চকলেট দাদু! আমাদের জন্য এনেছ চকলেট?”
তাঁর নামকরণ হয়েছে চকলেট দাদু! জানতেন না তো! অনেক দিন পর প্রাণ খুলে হাসলেন হিরণ্ময়বাবু। তার পর পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক মুঠো চকলেট বার করে দু’জনের হাতে দিলেন।
চকলেট পেয়ে তাদের কী আনন্দ! এই অপাপবিদ্ধ বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে তাঁর মন স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। পাখপাখালির মিষ্টি কিচিরমিচির স্পন্দিত হতে লাগল তাঁর মস্তিষ্কে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।
“তোদের নাম বললি না তো!” হাসিমুখে বললেন তিনি।
“আমার নাম চন্দ্রিমা, ও হল ঋদ্ধিমা। আমরা দু’বোন।... কিন্তু তুমি হাঁটতে পারো না দাদু? কী হয়েছে তোমার?” চন্দ্রিমা জিজ্ঞেস করল।
“হাঁটব কী করে, আমার পায়ে বাতের অসুখ।”
“তাতে হাঁটতে পারবে না কেন! আমাদের দাদুরও পায়ে বাত। দাদু তো নিজে নিজে হাঁটে।”
“তোর দাদুর নিশ্চয়ই বাত কম। আমার যে খুব বেশি রে!”
এর মধ্যে বাচ্চা দুটোর মা চলে এসেছেন। ভদ্রমহিলা হিরণ্ময়বাবুর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, “খুব জ্বালাচ্ছে না আপনাকে! আমাকে বলে গেল, মা, চকলেট দাদুর কাছে যাচ্ছি। কোথা থেকে জেনেছে আপনি চকলেট দেন বাচ্চাদের!”
হিরণ্ময়বাবু হাসলেন, “না না, একদম বিরক্ত করেনি। আমি তো বাচ্চাদের দেব বলেই চকলেট নিয়ে আসি সঙ্গে করে। এই নিষ্পাপ শিশুগুলোকে দেখলে আমার মনটা ভরে যায়।”
ভদ্রমহিলা তাঁর দুই মেয়ের মুঠো করা হাতের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “এর মধ্যেই চকলেট নেওয়া হয়ে গেছে! দাও, ওগুলো আমার হাতে দিয়ে, দাদুকে প্রণাম করো।”
“থাক থাক, আর এই ধুলো পায়ে হাত দিতে হবে না। প্রণাম-ট্রনাম তো এখন উঠে গেছে।”
“না মেসোমশাই। এখন থেকেই এগুলো শিখে রাখা উচিত।”
চন্দ্রিমা আর ঋদ্ধিমা মায়ের হাতে চকলেটগুলো দিয়ে, প্রণাম করল হিরণ্ময়বাবুকে। তার পর ভদ্রমহিলাও প্রণাম করলেন।
হিরণ্ময়বাবুর এক আশ্চর্য অনুভূতি হল। মনের মধ্যেকার অবসাদের মেঘ যেন মুহূর্তে কেটে গেল। তাঁর হৃদয়ে অনুরণিত হতে লাগল অপূর্ব সুরের মূর্ছনা। মহাপ্রলয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি যেন অনন্তময় এক জীবনের আস্বাদ পেলেন। তাঁর যদি এ রকম নাতি-নাতনি থাকত!
ফিরে যেতে যেতে চন্দ্রিমা আর ঋদ্ধিমা এক সঙ্গে বলে উঠল, “কাল আবার আসব দাদু।”
হিরণ্ময়বাবুর মুখটা আলোকিত হয়ে উঠল এক অনাস্বাদিত ভালবাসার ছোঁয়ায়।
বেলা পড়ে এসেছে। এ বার তপতী আসবে তাঁকে নিয়ে যেতে।
পরদিন হিরণ্ময়বাবু তপতীকে বললেন, “আজকেও দুপুরেই পার্কে যাব, বুঝলি! সকালে আর বেরোব না।”
“কেন, সকালে বেরোবে না কেন? আজ তো আর কুয়াশা হয়নি!” তপতী বলল।
“না হোক, শীতকালটা দুপুরবেলাই যাব পার্কে।”
“তাই যেয়ো। তোমার যখন যেতে ভাল লাগবে, তখনই যেয়ো।”
দুপুরে পাঞ্জাবির দু’পকেট ভর্তি চকলেট নিলেন হিরণ্ময়বাবু। বেশ কয়েকটা হাতেও রাখলেন। তপতী হুইলচেয়ার চালিয়ে পার্কে নিয়ে গেল তাঁকে।
“যা, কালকের মতো বাড়ি গিয়ে ঘুম লাগা। ঠিক সময়মতো এসে নিয়ে যাস আমাকে,” তপতীকে আদেশ করলেন তিনি।
“ঠিক আছে,” বলে চলে গেল তপতী।
কিছু ক্ষণ পরই ঋদ্ধিমা আর চন্দ্রিমা ছুটতে ছুটতে এল তাঁর কাছে।
“তোরা এসে গেছিস? এই নে চকলেট,” বলে দু’জনকে দু’মুঠো চকলেট দিলেন তিনি।
ঋদ্ধিমা বলল, “দাদু, আমাদের দাদু যখন হাঁটতে পারে, তুমিও পারবে।”
“না রে, তোদের দাদুর চেয়ে আমার অসুখ অনেক বেশি। আমি পারব না।”
“কিচ্ছু বেশি নয়। তুমিও হাঁটতে পারবে। আমরা তোমাকে হাঁটাব আজ।”
চন্দ্রিমা হিরণ্ময়বাবুর একটা হাত ধরল। আর একটা হাত ধরল ঋদ্ধিমা।
“উঠে দাঁড়াও দাদু। তুমিও হাঁটতে পারবে আমাদের দাদুর মতো,” চন্দ্রিমা বলল।
“পারব বলছিস?”
“খুব পারবে। আমরা তো ধরে আছি তোমাকে।”
“আর পড়ে গেলে?”
“কিচ্ছু পড়বে না। ওঠো।”
দু’পাশ থেকে দু’জনে ধরল তাঁকে। চন্দ্রিমা বলল, “এ বার ওঠো দাদু। আমরা ধরে আছি তোমাকে শক্ত করে।”
বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে শিশুর মতো হাসলেন হিরণ্ময়বাবু। অনেক দিন পর শরীরে যেন বেশ বল পেলেন। আশপাশে তাকিয়ে কয়েক বারের চেষ্টায় আস্তে আস্তে হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দু’টি বাচ্চা দু’দিক থেকে শক্ত করে ধরে রইল তাঁর দু’হাত।
“দেখলে তো দাদু, কী সুন্দর দাঁড়ালে তুমি!” ঋদ্ধিমা হাসল।
“হ্যাঁ রে, দাঁড়ালাম তো। এ বার বসে পড়ি?”
“না না। বসবে না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো একটু,” চন্দ্রিমা বলল।
বেশ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার পর, ঋদ্ধিমা বলল, “এ বার হাঁটো দাদু। আস্তে আস্তে, আমরা ধরে আছি তোমাকে।”
“হাঁটতে পারব বলছিস?”
“কেন পারবে না। খুব পারবে। কী সুন্দর দাঁড়ালে বলো তো!” চন্দ্রিমা শক্ত করে চেপে ধরল তাঁর হাত।
এ বার আস্তে আস্তে এক পা, এক পা করে পার্কের একটা সাইড ধরে হাঁটতে লাগলেন তিনি। না। কোনও কষ্ট হচ্ছে না তাঁর। কোনও ব্যথা অনুভব করছেন না। এক আশ্চর্য শক্তি যেন ভর করেছে তাঁর শরীরে। আর, দু’পাশে তাঁকে ধরে রয়েছে দু’টি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে।
কিছুটা হেঁটে গিয়ে, পার্কের বেঞ্চিতে বসলেন। চন্দ্রিমা আর ঋদ্ধিমা তাঁর দু’পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
মিনিট দশেক পর চন্দ্রিমা বলল, “চলো দাদু, তোমাকে বসিয়ে দিয়ে আসি। কাল আবার হাঁটবে।”
আগের মতোই দু’জনকে ধরে-ধরে উঠে ধীর পদক্ষেপে হাঁটতে লাগলেন হিরণ্ময়বাবু। তাঁর যেন মনেই হল না, বহু দিন পর তিনি হাঁটছেন।
চন্দ্রিমা আর ঋদ্ধিমা এ বার হাত ছেড়ে দিয়েছে। নিজে-নিজেই হাঁটছেন হিরণ্ময়বাবু। তিনি খেয়ালও করলেন না যে, তাঁকে আর কেউ ধরে নেই।
হুইলচেয়ারে বসার পর চন্দ্রিমা বলল, “বাড়িতে কিন্তু একা একা হাঁটবে না দাদু। আমরা কাল আবার তোমাকে হাঁটাব।”
যেমন ছুটতে ছুটতে এসেছিল, সে রকমই ছুটতে ছুটতে ফিরে গেল তারা। হিরণ্ময়বাবু অনাবিল স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সে দিকে, অপলক।