আলোর দিশা দেখাত...
বাংলার জলজ পরিবেশে কাঠুরিয়া আর দাবানলের জায়গা নিয়েছে বণিকের তরী আর সমুদ্রের প্লাবন। এমনকি ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর সূত্র ধরে ধনপতি সদাগরেরও দেখা মেলে এই ব্রতকথাগুলিতে। একমাত্র পাখিতে হিরের হার চুরি করার বিরল ঘটনাটিই দু’টি আখ্যানের মধ্যে আত্মীয়তাসূচক। তবে গুজরাতে যেখানে পাখি উড়তে উড়তে হার ফেলে দিচ্ছে, বাংলায় সেখানে ময়ূর নাচতে নাচতে বমি করে হার বার করে দিয়েছে।
তবে পার্সি-হিন্দু আদানপ্রদানের মাঝখানে কিন্তু বাঙালি ইসলামের কথা ভোলার উপায় নেই। নক্সবন্দিয়া-মুজাদ্দিদিয়াদের আড়ম্বর বাদ দিয়ে সাধারণ মুসলমান ঘরের গৃহলক্ষ্মীদের মধ্যেও মুশকিল আসানের ব্রত উদ্যাপনের চল ছিল। ওয়াইজ় সাহেব জানান যে, বাঙালি মুসলমান মহিলারা এই মুশকিল আসানদের সঙ্গে যুক্ত দু’টি আচার পালন করতেন। প্রথমটি পালিত হত ইংরেজি নভেম্বর মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার। যাঁরা এই আচার পালন করতেন, তাঁরা বৃহস্পতিবার সারা দিন উপোস করে, শুক্রবার হালুয়া এবং ‘চিৎওয়াহ’ বলে এক ধরনের মিষ্টি খেয়ে উপোস ভাঙতেন। দ্বিতীয় আচারটি পালন করা যেত যে কোনও ইসলামি মাসের সাত, সতেরো বা সাতাশ তারিখে। আচারটিকে বলা হত ‘মুশকিল কুশা’, যা মোটামুটি মুশকিল আসানেরই সমার্থক। এই মুশকিল কুশার আচারবিধির মধ্যে ছিল বাড়ির কোথাও একটি নুনের পাত্র ও কুঁজো স্থাপন করে বৃহস্পতিবার উপোস করা। উপোস ভাঙা হত জিলিপি এবং নকুলদানা সহকারে।
যদিও ওয়াইজ় সাহেব ‘ব্রত’ শব্দটির ব্যবহার করেননি, তবুও দু’টি আচারের বিবরণ থেকে মনে হয়, এগুলো সাধারণ মেয়েলি ব্রতই ছিল। এর সঙ্গে হয়তো কোনও ব্রতকথাও যুক্ত থেকে থাকতে পারে। কিন্তু ওয়াইজ় সাহেব সে কথা জানাননি।
তবে এখানেই যদি মুশকিল আসানের ইতিহাসের ইতি হত, তবে একটা বেশ পরিচ্ছন্ন আখ্যান সাজানো যেত। প্রাচীন ঋগ্বেদীয় যুগের অগ্নি-উপাসনার ছায়া কী ভাবে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে বিবর্তিত হয়েছে, তাই দেখিয়ে ব্যাপারটাকে সমাধা করা যেত। কিন্তু সমকালীন ইতিহাস এমন সরল সমাধানের পক্ষপাতী নয়।
ষাটের দশকের পরে, সম্ভবত আশি-নব্বইয়ের দশকে কোনও সময়, ক্যানিং স্ট্রিটের একটি ছাপাখানা থেকে ছাপা হয় একটি চটি বই। বইটির নাম ‘মুশকিল আসান ব্রতকথা’। লেখক মহসিন পির। প্রচ্ছদে রয়েছে অবন ঠাকুরের বাল্যস্মৃতির সেই মুশকিল আসানের ছবি। কিন্তু ভিতরের গল্পের সঙ্গে গুজরাতি ব্রতকথা কিংবা বিক্রমপুরের কথার কোনও মিল নেই। এমনকি এই ব্রতকথাটি মুশকিল আসান বলে কোনও সত্তার গল্পই নয়। এই নতুন আখ্যানের উপাসনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন আসানবিবি।
যদিও বনবিবি, ওলাবিবি প্রমুখ বাংলার নানা মুসলমান দেবীস্বরূপা বিবিদের মধ্যে কদাচিৎ আসানবিবির নামও শোনা যায়, তবে তিনি যে তেমন জনপ্রিয় বিবি তা বলা চলে না। বাংলার পির-সাহিত্যের অক্লান্ত গবেষক গিরীন্দ্রনাথ দাস তাঁর দু’টি বইতে বাংলার নানা বিবি, গাজি, পির, পিরানির সন্ধান দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর লেখায় কোথাও আসানবিবির উল্লেখ নেই। বছর বিশেক আগে লোকসংস্কৃতি-গবেষক দেবব্রত নস্কর যখন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় পালাগানের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রসমীক্ষা করেন, তখন তিনিও আসানবিবি সংক্রান্ত মাত্র একটিই গান খুঁজে পান। সেই একটিমাত্র গানও আবার অনেক জায়গায় ওলাবিবির গান হিসেবেই গাওয়া হয়ে থাকে।
আরও অভাবনীয় ঘটনা হচ্ছে এই নতুন ব্রতকথাটির গল্পটি। বিক্রমপুরের ব্রতকথাটিতে যেখানে সকল চরিত্রই মোটামুটি হিন্দু বলে মনে হয়, নতুনটিতে প্রত্যেকটি চরিত্রের নামই ইসলামধর্মী। আখ্যানটির অকুস্থল হল ইশা খাঁ নামক এক বাঙালি রাজার রাজত্ব। গল্পের বিষয়বস্তু কিছুটা এই রকম: মগ দস্যুদের উৎপাতের চোটে, এবং তাদের কমবয়সি মেয়ে চুরি করার প্রবণতার চোটে রাজ্যে এক অদ্ভুত আইন জারি করা হয়— কারও কন্যাসন্তান জন্মালেই সন্তানটিকে হত্যা করা হবে। তবে রাজা বহুকাল রাজত্ব করে ক্লান্ত। তিনি চান মৃগয়া করতে যেতে। এ দিকে রানি আবার অন্তঃসত্ত্বা। তাই রাজা যাওয়ার আগে তাঁর প্রিয় জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ খাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে নির্দেশ দিয়ে যান যে, রানির কন্যাসন্তান জন্মালে যেন তৎক্ষণাৎ তাকে হত্যা করা হয়।
চাঁদ খাঁ-র কিন্তু এই আইন ঘোরতর অন্যায় বলে মনে হয়। যখন সত্যিই তার মায়ের একটি কন্যাসন্তান হয়, সে শিশুটিকে হত্যা তো করেই না, বরং সারা রাজত্বে হুকুম জারি করে যে, তার বোনের কোনও রকম অনিষ্ট হলে সেই অনিষ্টের জন্য যে দায়ী, চাঁদ খাঁ নিজে তাকে বধ করবে। রাজকন্যা শিরিন তাই রক্ষা পেয়ে আদরে মানুষ হতে থাকে। চোদ্দো বছর পরে যখন ইশা খাঁ ফিরে আসেন, তখন তাঁর আইন ও হুকুম দুই-ই অমান্য করা হয়েছে দেখে তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। তবে কন্যাকে বধ করতে গিয়েও তিনি তা করতে পারেন না, হাজার হোক বাবা তো। তাই শিরিনকে তিনি নির্বাসিত করেন। এ দিকে চাঁদ খাঁ বলে, দোষ যদি কেউ করে থাকে তো সে, অর্থাৎ চাঁদ খাঁ নিজে। বোনের কোনও দোষ নেই। এটা অবিচার। যুক্তির অকাট্যতা স্বীকার করে ইশাকে তাই তাঁর প্রিয় পুত্র চাঁদকেও নির্বাসিত করতে হয়।
নির্বাসনে ভাই-বোন কোনও মতে দিন চালায়। চাঁদ আর এক রাজার সৈন্যদলে ভর্তি হয়ে মোটামুটি উপার্জন করতে থাকে। বোনকে সে কয়েকটি পাখি কিনে দেয়। সে বলে, যত দিন শিরিন পাখিগুলিকে খাইয়েদাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবে, চাঁদও সুস্থ থাকবে। এ দিকে শিরিন কিছু দিন বাদে পাখিগুলোকে খাওয়াতে ভুলে যায়। পাখিদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে চাঁদও মারা যায়। তখন শোকাহত শিরিন আসানবিবির দেখা পায়। শিরিন তাঁর পুজো করায় চাঁদ তো বেঁচে ওঠেই, ইশা খাঁ-ও তাঁর পুত্রকন্যাকে ফিরিয়ে নিতে
বাধ্য হন। চাঁদের কথায় ইশা কন্যা-হত্যার আইনও প্রত্যাহার করেন।
সম্প্রতি এই আখ্যানটির আর একটু বিবর্তন হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে লেখকের নাম মহসিন পিরের জায়গায় শ্যামাচরণ ভট্টাচার্যের ছাপা হচ্ছে। দুটোর কোনও নামই ঠিক কি না সন্দেহজনক। খুব সম্ভব দু’টিই ছদ্মনাম। আখ্যানের সামান্য রদবদল হয়েছে, তবে তা এখানে আলোচনার অবকাশ নেই।
গত কয়েক দশকের এই ইতিহাসটি কিন্তু আমাদের আগের ইতিহাসটিকেও পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। সত্যিই কি ইতিহাসের ধারাকে প্রাচীন হিন্দু, মধ্যযুগীয় ইসলামীয় বা উনিশ শতকীয় আধুনিকতার মতো কয়েকটি ক্রমিক বর্গে সুবিন্যস্ত করা যায়? বিশেষ করে আলোচনার বিষয় যখন মানুষের বিশ্বাস বা আচার! রাষ্ট্রের ইতিহাস হয়তো বা রৈখিক হতে পারে। ধর্মের তাত্ত্বিক আলোচনারও হয়তো একটা রৈখিক মানচিত্র এঁকে ফেলা সম্ভব। কিন্তু বিশ্বাস? আচার? এ সব কি কখনও সোজা পথে চলে? সময়ই তো সেখানে বহু ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ, বিবিধ জটে জড়ানো। চোখের সামনে দেখছি মুশকিল আসানের জোব্বা-জুব্বি পরা চিত্রটা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আসানবিবির নবকলেবরে। এর কতটা হিন্দু, কতটা পার্সি, আর কতটা মুসলমানি— কে বলে দেবে? এই একুশ শতকেও নতুন দেবী, থুড়ি বিবির, আবির্ভাব ঘটছে। একে কি প্রাচীন বলব, না অর্বাচীন?
ইতিহাসের মাপা সময়ের গণ্ডির বাইরে কত গল্প যে ধীরে ধীরে অন্য গল্পে মিলে যাচ্ছে, নিভৃতে নব রূপে রূপান্তরিত হচ্ছে, কে তার হিসাব রাখবে? আর সে হিসাবে কাজই বা কী? তার চেয়ে গল্পগুলিই বরং ভাল। ইতিহাসের ও সব বর্গীকরণের ধাঁধায় না পড়ে বরং অবন ঠাকুরের সুরে সুর মিলিয়ে বলি, “গরিব পরবৎ সেলাম। অব আগাজ কিসসেকা করতা হুন— জ়রা কান দে কে সুনো...”