এই নিয়ে পর পর তিন দিন বাড়ি ফেরার পথে আমার সঙ্গে সাপটার দেখা হল। মঙ্গল, বুধ আর
আজ বৃহস্পতি। একই সময়ে, একই জায়গায়।
জায়গাটা চেনা সহজ, এখানে ফুটপাতের গায়ে একটা বড় কাঠবাদামের গাছ আছে। মন বলছিল, আজও সাপটাকে এখানেই দেখতে পাব। পেলাম সত্যিই। ফুটপাতের উপরেই শুয়ে ছিল। যেন আমারই প্রতীক্ষা করছিল। পায়ের শব্দ পেয়েই এক বার মাথাটা তুলে আমার মুখের দিকে তাকাল। তার পর মাথা নামিয়ে নিল।
এখন রাত ন’টা। সল্টলেকের রাস্তায় লোকজন আর গাড়ির সংখ্যা কমে এসেছে। কাঁধে অফিসের ব্যাগ নিয়ে সাপটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাঁ দিকে সল্টলেকের বিএল ব্লক, সারিবদ্ধ একতলা-দোতলা বাড়ি। বসন্তবাতাসে কিছু বাড়ির জানলার পর্দা উড়ছে। একটা বিলিতি কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছি। এত গম্ভীর সেই ডাক যে, মনে হচ্ছে পাতাল থেকে উঠে আসছে।
ডান দিকে একটা নোংরা খাল। খালটার ও পাশেই আলোকিত বড়রাস্তা, যার নাম বিশ্ববঙ্গ সরণি। নাকি, বিশ্ববাংলা সরণি? ঠিক মনে পড়ছে না। যা-ই হোক, সেই সরণিটির ও পাশে আবার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর বহুতল দফতরের সারি। চার দিকে এত আলো, তবু খালের বুকটা কী ভাবে যেন সমস্ত আলো শুষে নেয়। ওখান থেকেই ফুটপাতে অন্ধকার উঠে আসে। অন্ধকারের সঙ্গে উঠে আসে ওই সাপ।
এখন আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি। প্রতিদিন এই সময়েই ফিরি, কিন্তু এই রাস্তা ধরে ফিরি না। এটা দিয়ে ফিরলে অনেকটা বেশি ঘুরতে হয়। গত তিন দিন এক বিশেষ কারণে এই রাস্তাটা ধরতে হচ্ছে।
ঘড়ির কাঁটা ন’টার ঘর পেরিয়ে গিয়েছে। খিদে পেয়েছে, ক্লান্তও লাগছে খুব। আর কিছুটা হাঁটলেই বাড়ি পৌঁছে যেতাম। কিন্তু সাপটাকে এই ভাবে একা রেখে দিয়ে আমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল যাইনি। আজও যাব না। ওকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রেখে তার পর বাড়ি যাব।
মঙ্গলবার সাপটাকে সরিয়ে দিয়েছিল এক বুড়ি। গতকাল আমি। আজও আমাকেই সরাতে হবে।
আমি নই, প্রথম দিনে বুড়িই সাপটাকে আগে দেখেছিল। এখন হয়তো বুড়ি এই শহরের কোনও বাজারে শাকপাতা কিংবা ফুলটুল বিক্রি করে, কিন্তু আদতে তো ওরা বাদা অঞ্চলের মানুষ, তাই আলটপকা জায়গাতেও সাপকে সাপ বলে চিনতে ভুল করেনি। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলেছিল, “ও মা! লতা যে গো!”
আমি পিছন থেকে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী?”
“মা মনসার বাওন। এক্কেরে আস্তার মদ্যিখানে শুইয়ে আচে। আরেট্টু হলি দিতুম গায়ে পা চাইপে।”
তখন আমিও সাপটাকে দেখলাম। কী জাতের সাপ ঠিক বুঝতে পারলাম না। প্রায় ফুট চারেক লম্বা, সাইকেলের টায়ারের মতো মোটা। শুকনো পানের পিকের মতো গায়ের রং। তার ওপরে ফুটকি ফুটকি ছোপ। বুড়ি হাততালি দিল, ফুটপাতে পা ঠুকে ধপ ধপ শব্দ তুলল। ফলে সাপটা খুব অনিচ্ছুক-ভঙ্গিতে ভারী শরীরটাকে টেনে নিয়ে খালপাড়ের ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে গেল।
বুড়ি যেতে-যেতে মন্তব্য করে গেল, “মরনির প্যাখনা গইজেচে। নইলে মানষির চলার পথে শুইয়ে থাকতি যাবে কেন? দিত কেউ এক্ষুনি মাতাটা ইট দে ছেঁচে।”
বুড়ির ওই শেষ কথাটা মানতে পারলাম না। আমার মনে হল, মরার জন্যে রাস্তায় উঠে আসেনি সাপটা। বাঁচার জন্যেই এসেছে। অনেক সময় আসতে হয়।
এটা প্রথম দিনের কথা। আজকেও ফুটপাতের কমলা রঙের টালির সঙ্গে রং মিলিয়ে শুয়েছিল সাপটা। মাঝে মাঝে চেরা জিবটা বার করে বাতাস শুঁকছিল। মাথার উপর দিয়ে শিয়ালদার দিকে শেষ মেট্রো চলে গেল। অদ্ভুত লাগল। অত্যাধুনিক এবং আলোকিত এক সরীসৃপ যেন হাওয়ায় ভেসে যেতে-যেতে, নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে গেল তার কুৎসিত আদিম পূর্বপুরুষকে।
আমি একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে সাপটাকে বললাম, “লড়ে যা ভাই। হাল ছাড়িস না। বুড়ি যা-ই বলুক, সুইসাইডের কথা মাথায় আনিস না। জানিস তো, আত্মহত্যা মহাপাপ।”
সাপটা নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন? পাপ কেন?”
ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারলাম না। পারলাম না বলেই খচে গেলাম। বললাম, “অত জানি না। শাস্ত্রে বলেছে পাপ, তাই পাপ। তুই এবার ফোট এখান থেকে। ওই দেখ, বড়লোকের বাড়ির চাকর তাদের অ্যালসেশিয়ানকে পটি করাতে আনছে। তোকে দেখতে পেলে মেরে ফেলবে।”
সাপটা সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকাল। দেখলাম, দুটো চোখ যেন দু’ফোঁটা জমাট অগ্নিবিন্দু। বলল, “কেন যাব? রাস্তাই তো এখন আমাদের একমাত্র রাস্তা।”
সোমবার বাস থেকে করুণাময়ীর মোড়েই নেমেছিলাম, যেমন প্রতিদিন নামি। ওখান থেকে আমার বাড়ি পর্যন্ত বাকি রাস্তাটুকু হেঁটে ফিরি। না হাঁটলে ভুঁড়ি বেড়ে যায়। মোড় থেকে ডান দিকে যে রাস্তাটা আনন্দলোক হাসপাতালের দিকে চলে গেছে, সেটার সার্ভিস রোড ধরে হাঁটা লাগাই। কিছুটা গিয়ে বাঁ দিকে একটা ইট-বাঁধানো রাস্তা ঢুকে গেছে। ওটা দিয়ে শর্টকাটে বিএল ব্লকে আমার বাড়ি অবধি চলে যাওয়া যায়।
নির্জন রাস্তা। ধারে ধারে সোঁদাল, কাঞ্চন কিংবা জারুলের মতো বেশ কিছু বড় গাছ। এক এক সিজ়নে এক এক রকমের ফুল ফোটে। স্ট্রিটলাইটের আলোয় ফুল দেখতে-দেখতে, শিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ি পৌঁছে যাই।
কিন্তু গত সোমবার করুণাময়ীর মোড়ে নেমে দেখতে পেলাম, ডান দিকের রাস্তায় ডামাডোল। চাকুরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েরা পুরো সার্ভিস রোড জুড়ে ধর্নায় বসেছে। মোড়ের পানওলাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, প্রথমে ওরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিসের সামনেই বসেছিল। পুলিশ ওখানে বসার অনুমতি না দেওয়ায় সার্ভিস রোডে গিয়ে বসেছে। গাড়ি চলাচল বন্ধ। পথচারীরা কোনও রকমে যাতায়াত করছে।
কী আর করব? ওদের অবস্থান-বিক্ষোভের পাশ দিয়েই হাঁটা লাগালাম। অসুবিধে হচ্ছিল হাঁটতে। এক দিকে রাস্তায় খবরের কাগজ পেতে ওরা বসে আছে। ওদের ঘিরে বিধাননগর পুলিশের ব্যারিকেড— চাকা-লাগানো গার্ড রেল-টেল— যেমন থাকে আর কী। চার দিক পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ। এক জায়গায় দেখলাম সার দিয়ে ক’টা টিভি চ্যানেলের ওবি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ছবি-টবি উঠছে।
টিভি-স্ক্রিন আর খবরের কাগজের পাতার নিরাপদ দূরত্ব থেকে খবর যখন এই ভাবে ঘাড়ের উপরে এসে পড়ে, তখন আমার ভারী অস্বস্তি হয়। মনে হয়, নিজেও খবর হয়ে যাব না তো? সরকারি চাকরি করি, অনেক দিক বাঁচিয়ে চলতে হয়। তাই ক্যামেরা এবং পুলিশের থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে যত দ্রুত সম্ভব জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তাও ভিড়ের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে যাচ্ছিলাম মাঝে মাঝে।
আমার পিছন থেকে এক টাকমাথা মাঝবয়সি ভদ্রলোক বললেন, “বিপ্লব করার আর জায়গা পায় না। রাস্তা আটকেই বসতে হবে বাবুদের।”
একটা বছর চারেকের বাচ্চা মেয়ে তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিসের পুজো হচ্ছে মাম্মাম? ঠাকুর কোথায়?”
লুঙ্গি পরা এক জন মিস্তিরি-টাইপের লোক একটু টেনে টেনে বলল, “চাগরি কি কোথাও আছে রে বাপ, যে তুদের দিবে? সমস্ত কোম্পানিরে এরা বেচে খেইছে।”
আই টি সেক্টরের একটা দুধসাদা বাস জ্যামে আটকে গিয়েছিল। বাসের জানলার ধারে বসা একটি ছেলে, ওই রাস্তায় যারা বসে আছে তাদেরই সমবয়সি হবে, সুগন্ধি টিস্যুপেপারে ঘাড়ের ঘাম মুছে পাশের মেয়েটিকে বলল, “দ্য কোয়েশ্চন ইজ় লাইক, আর দে এলিজিবল ফর এনি জব অ্যাট অল?”
বাচ্চাটির মা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, “অটো ছাড়া এতটা রাস্তা হেঁটে যেতে কষ্ট হয় না? এরা কি কারও কথাই ভাববে না?”
মাঝবয়সি ভদ্রলোক তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আমার ভাগ্নি মিডিয়ায় আছে। জার্নালিস্ট। ও বলছিল, পুলিশ নাকি জাস্ট কোর্টের অর্ডারের জন্যে অপেক্ষা করছে। অর্ডার পেলেই এদের মেরে তুলে দেবে।”
বাচ্চা মেয়েটা বলল, “মাম্মাম দেখো। একটা আঙ্কল না বিড়ি খাচ্ছে!”
ঠিক এই সময়েই আমি দেখলাম, বকাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মাসতুতো ভাই বকাই। ভাল নামটা কী যেন? সৌম্যেন্দু বোধহয়। সৌম্যেন্দু হালদার। বিক্ষোভকারীদের জমায়েতের মধ্যে বসে বকাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
অনেক দিন দেখা হয়নি। অনেক দিন মানে প্রায় পাঁচ বছর। ওদের বাড়ি শেষ গিয়েছিলাম সেই ফুলমাসির শ্রাদ্ধে। সেই জন্যেই একটু আশা ছিল, ও হয়তো আমাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু আমার চোখে চোখ পড়ামাত্রই বকাইয়ের মুখে ওর মার্কামারা চওড়া হাসিটা ফুটে উঠল। চিনতে পেরেছে। আমাকে ডাকার জন্যে ও ডান হাতটা তুলছে। এইটুকু দেখেই আমি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে প্রাণপণে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
এক বার কি ও পিছন থেকে ‘ছোড়দা! এই ছোড়দা!’ বলে ডেকেছিল আমাকে? নিশ্চিত নই। অনেক রকম আওয়াজ ছিল জায়গাটায়। তার মধ্যে হ্যান্ডমাইকে আন্দোলনকারীদের বক্তৃতাটাই সবচেয়ে জোরে বাজছিল। তবু মনে হয় ডেকেছিল। বকাই তো আমাদের সঙ্গে মিশতে চায়। আমাদের ডাকে। আমরা সাড়া দিই না। আমি দিই না। আমার অন্যান্য মামাতো মাসতুতো ভাইবোনেরাও দেয় না।
ছোটবেলায় ও আমাদের সঙ্গে খেলতে এলে বিরক্ত হতাম, ওর প্যান্টের বোতাম ছেঁড়া আর জামার কলার ফাটা বলে। এখন ওকে আমরা এড়িয়ে চলি ওর চাকরি নেই বলে। টিউশনি-ফিউশনি করে, কিন্তু তাকে কি আর চাকরি বলা যায়?
বকাই আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। তার মানে ওরও তো পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেল। এখনও চাকরির জন্যে ধর্না দিচ্ছে কী করে? এজ লিমিট বলে কিছু নেই নাকি?
অনেক দূর চলে এসে এক বার চুপিচুপি ঘাড় ঘুরিয়ে ও দিকে তাকিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বকাইয়ের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে এসেছি। ভুল ভেবেছিলাম। দেখলাম, ও অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বারের মতো ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সোজা বাড়ি
চলে এসেছিলাম।
বাড়ি ফিরে রঞ্জাকে আসার পথে যা-যা হল, তার সবটাই খুলে বলছিলাম। এমনই কো-ইনসিডেন্স, আমার কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখি বকাই ফোন করেছে। রঞ্জা ফিসফিস করে বলল, “একদম ধরবে না। তার পর হয়তো বন্ধুবান্ধব নিয়ে এখনই আমাদের বাড়িতে খেতে চলে এল। হয়তো বলল, ‘বাথরুমটা ইউজ় করব,’ তখন কী করবে?”
“ধরব না?”
“না। এমনিতেও কোনও সম্পর্ক নেই, ওমনিতেও থাকবে না। এ সব এলিমেন্টের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকাই ভাল।”
বললাম, “বেশ।”
“আর কাল থেকে ওই রাস্তাটা অ্যাভয়েড করবে। অন্য কোনও রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরবে… যত দিন ওরা ওখানে ঘাঁটি গেড়ে আছে।”
ঘাঁটি গাড়া কথাটা খুব কানে লাগল। সন্ত্রাসবাদী নাকি যে ঘাঁটি গেড়ে থাকবে? কিন্তু রঞ্জাকে কিছু বললাম না। এটা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার সময় নয়। কাঁধে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
মনকে শান্ত করা চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারছিলাম না। কেবলই মনে হচ্ছিল, আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সে কি এক বার হাসিমুখে ব্যারিকেডের পাশে দাঁড়িয়ে হাতটা ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিত না?
হুঁশ ফিরতেই দেখি বাথরুমের ভিতরে আমি দেওয়ালের দিকে ডান হাতের পাতাটা বাড়িয়ে ধরে, ফিসফিস করে বলছি, “উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট বকাই। তোরা জিতে যাবি, দেখিস।”
লজ্জিত হয়ে হাতটা সরিয়ে নিলাম। নিজেকে বোঝালাম, আমার পরিস্থিতিতে পড়লে যে কেউ আমার মতো করেই রিঅ্যাক্ট করত। এটাই স্বাভাবিক।
রাতে শোওয়ার পরও বার বার এ পাশ-ও পাশ করছিলাম। এক বার মনে পড়ল, ফুলমাসি আমাকে খুব ভালবাসত। আমার ডাকনামটা ফুলমাসিরই দেওয়া। মনে পড়ল, মামাবাড়ির সামনের রাস্তায় সাইকেল চালাতে চালাতে পড়ে গিয়ে আমার পা-টা অনেকখানি কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে বেশ, কিন্তু আমি কাঁদছি না। কাঁদছে বকাই। আমার হাতটা মুঠো করে চেপে ও তারস্বরে কাঁদছে আর বলছে, “ছোড়দা পড়ে গেছে। ছোড়দা পড়ে গেছে।”
রঞ্জা পাশ থেকে বলল, “কী হল? এত ছটফট করছ কেন?”
বললাম, “বকাই এমন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল! ওই দৃষ্টিটা ভুলতে পারছি না।”
রঞ্জা বলল, “মোটেই অবাক হয়নি। অবাক হবে কেন? তোমার এই ভাইটিকে আমি দেখেছি। ওর চোখে সব সময়েই কেমন একটা ভেকেন্ট… একটা নির্বোধ দৃষ্টি লেগে থাকে। থাকে না? বলো। তোমার গিল্ট ফিলিং থেকে তুমি সেই ভেকেন্ট দৃষ্টির একটা মানে করে নিয়েছ। আর কিছু নয়।”
আমিও কেমন নির্বোধ দৃষ্টিতে তাকাই, “বলছ?”
“হ্যাঁ, বলছি। এ বার ঘুমোও।”
যাতে রঞ্জা শুনতে না পায়, এই ভাবে শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে বললাম, “উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট বকাই। তোরা ঠিক জিতে যাবি।”
পরদিন থেকে রাস্তা বদলালাম, আর সেই বিকল্প রাস্তাতেই সাপটার সঙ্গে দেখা হতে লাগল। মঙ্গল, বুধ আর বৃহস্পতি… পর পর তিন দিন।
শুক্রবার অফিস থেকে ফেরার পথে করুণাময়ীর মোড়ে এসে বুঝলাম, ইচ্ছে করলে আবার আমি আগের রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরতে পারি, কারণ, অবস্থানকারীদের পুলিশ তুলে দিয়েছে।
সার্ভিস রোডটা ফাঁকা। সেই চাকুরিপ্রার্থী যুবক-যুবতীরা কেউ নেই। শুধু কয়েক জন সিভিক ভলান্টিয়ার গার্ড-রেলগুলোকে টানতে টানতে রাস্তার ধারে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শেষ ওবি-ভ্যানটা গুটিগুটি সার্ভিস রোড ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মেন রোডের দিকে। রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ছেঁড়া খবরের কাগজ, জলের বোতল, চটিজুতো, এই সব। সব কিছুর উপরে ছড়িয়ে আছে সোঁদালের হলুদ পাপড়ি। মিউনিসিপ্যালিটির সুইপাররা এর মধ্যেই সেগুলোকে ঝাঁট দিয়ে সরাতে শুরু করেছে।
যেতে পারতাম, পুরনো রাস্তা ধরেই বাড়ি যেতে পারতাম, কিন্তু গেলাম না। পা-দুটো খুব ভারী লাগছিল। পিঠে যেন কেউ একটা বস্তা তুলে দিয়েছে। কোনও রকমে শরীরটাকে টানতে-টানতে নিয়ে চললাম সেই যেখানে মেট্রোর লাইনের নীচে বাদাম গাছ। বাঁ হাতে আলোকিত বাড়ি, ডান দিকে অন্ধকার জল। যেখানে সাপ।
সাপটা আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল। আমি বললাম, “পারলি না?”
“তোমরা যে সাপোর্ট দিলে না, ছোড়দা।”
“চল, রাস্তা ছাড়।”
“কেন রাস্তা ছাড়ব? রাস্তাই তো আমাদের একমাত্র রাস্তা।”
“রোয়াবি হচ্ছে?” আমি একটা বড়সড় ইটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে সাপটার মাথা টিপ করে ছুড়লাম, “মর শালা!”
আর একটা ইট… “মর শালা”...
আর একটা… “মর...”