বুদবুদ ওড়ানোর মেশিনে শিশুর ফুঁ দেওয়ার মতো সিগারেটের তিনটি রিং উড়িয়ে দিলেন
উত্তমকুমার। চোখের পলকে রিং তৈরি
হয়েই গায়েব।
‘কোর্মা কালিয়া পোলাও, জলদি লাও জলদি লাও’ বলার পরে গুপী-বাঘা যেই না একে অপরের হাতে তালি বাজাল, আকাশ থেকে খাবার পড়তে শুরু করল উল্কাপাতের মতো। না না, ঠিকঠাক হল না তুলনাটা। ভূমিকম্প হলে কোনও বহুতল যেমন ঝপ করে মাটিতে মিশে যায়, খাবারগুলো ঠিক তেমন করে মহাকাশ থেকে ভূপতিত হল।
ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ুকে পিঠে চাপিয়ে চিতাবাঘের মতো দৌড়তে লাগল মরুভূমির জাহাজ। ফড়িঙের ডানার মতো নেচে উঠল লালমোহন গাঙ্গুলির হাত। উটের উপরে তিনি নিজেকে সামলাতে পারছেন না মোটে। স্প্রিংয়ের মতো নাচছেন, কাঁপছেন।
তিন দিন ক্রমাগত এমন ঘটনা দেখার পরে আমি আমার সহযাত্রীর পিঠে ক্রমাগত চাপড় মেরে খোলাতে বাধ্য করলাম তার দু’কানে গোঁজা ব্লুটুথ ইয়ারফোনের বাড। দমদম থেকে দক্ষিণগামী ন’টা দশের মেট্রোয় ও আমার পরিচিত মুখ। বয়স মেরেকেটে পঁচিশ। কোনও এক ইনশিয়োরেন্স সংস্থায় চাকরি পেয়েছে সদ্য। মোবাইলের স্ক্রিনে সিনেমা দেখার জন্যই জগতের ওটিটি-যজ্ঞে ওর আবির্ভাব হয়েছিল বোধ হয়। আগে সিনেমাগুলো সিনেমার মতো চলত। এখন ছন্দবদল। আমি আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে বলেছিলাম, “হচ্ছেটা কী ভাই? তুমি কি মানুষ? কী দেখছ এমন ভাবে, দিনের পর দিন?”
ছেলেটির নির্বিকার উত্তর, “এ বাবা! এটাও বুঝতে পারছেন না? আপনি কি মানুষ? মানুষ হলেও আপনি বাঙালির লজ্জা। আমি দেখছি রে রেট্রোস্পেক্টিভ। সত্যজিৎ রে, দ্য গ্রেট।”
ক্লাস এইটে এক বন্ধুকে কানচাপাটি দিয়ে ঘণ্টাদুয়েক ক্লাসের বাইরে নিলডাউন হয়েছিলাম। মনোজস্যর শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন, “আর কোনও দিন এমন বেয়াদপি করিব না।” ছেলেটির কথাগুলো শুনে হাত নিশপিশ করছিল। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “সে তো বুঝলাম। কিন্তু এমন ভাবে কেন?”
ছেলেটি বলেছিল, “এটা শুধু ক্রাক্স অব দ্য স্টোরি-র যুগ মশাই। দুনিয়া কিসে চলছে জানেন? সারাংশতে। যে কোনও লম্বা জিনিসকে কেটে ছোট করে নিতে হয় নিজের মনের মতো। দু’ঘণ্টার সিনেমার জন্য আমার ম্যাক্সিমাম বরাদ্দ আধঘণ্টা। স্টোরিটাও জানা গেল। চর্বিও কাটা গেল। কী বুঝলেন?” চোখ নাচাল। ওর জুলফিদুটো সজোরে টেনে ধরে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়েছিল, ‘সত্যজিতের সিনেমায় চর্বি? অ্যানাইহিলিন পিস্তল থাকলে এই মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে দিতাম তোমায়, খোকা। সাহস কত বড়!’ সামলে নিলাম ফের।
চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আমার আর কিছু করার উপায় ছিল না। সত্যজিতের পরে ঋত্বিক এলেন। তাঁর পরে শ্যাম বেনেগাল, স্পিলবার্গ। এলেন রাজকুমার হিরানি, অনুরাগ কাশ্যপ। তাঁদের চরিত্ররা পর্দায় ছুঁচোবাজির মতো দৌড়ে বেড়াল। কেউ সময় নষ্ট করল না এক সেকেন্ডের জন্য। বিস্ফারিত নয়নে চার পাশটা দেখতে দেখতে বুঝলাম, মেট্রোয় আমার এমন সহযাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ। বুঝলাম, যাঁরা সিনেমা দেখছেন, তাঁরা পরিচালকের অধীন নয়। বরং তাঁরাই পরিচালনা করছেন বরেণ্য পরিচালকদের। দশটা কিংবা বারোটা স্টেশনের সফরের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে একটা গোটা সিনেমা। এ এক অবাক করা ব্যাপার বটে।
গ্রামোফোন দেখিনি। তবে নব্বইয়ের দশকে বাড়ির টু-ইন-ওয়ানের কথা মনে পড়ে। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা স্বপ্ন-ক্যাসেটের দুটো পিঠ। এ পিঠ, বি পিঠ। এ পিঠের চতুর্থ গানটা শোনার ইচ্ছে হলে প্রথম তিনটে গান টপকে যেতে হত। টপকানোর উপায় ছিল দু’রকম। প্রথম উপায়, স্টপ টিপে বার বার ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে ফের প্লে বোতাম টিপে শুনে দেখা, ঠিক জায়গাটি এল কি না। দ্বিতীয় উপায়, প্লে হতে থাকা অবস্থায় ফরওয়ার্ড বোতাম চেপে ধরা। মুহূর্তের স্তব্ধতা এলে বোতামটি ছেড়ে দেওয়া হত। মানে আগের গান শেষ হয়েছে। এই প্লে চলাকালীন ফরোয়ার্ড চেপে ধরলে গানের সব কিছু তালগোল পাকিয়ে এক অদ্ভুত আওয়াজ বেরোত যন্ত্রের স্পিকার থেকে। গায়ক-গায়িকার কণ্ঠ হঠাৎ মিহি হয়ে গিয়ে কেমন যেন কিলবিল করত। কোনও এক ক্যাসেটে ‘ডুবি অমৃতপাথারে’, ‘পিপাসা হায় নাহি মিটিল’ কে এমন ভাবে টপকে যখন ‘আমরা সবাই রাজা’-র দিকে এগোচ্ছিলাম এক দিন, আর্তনাদ করে উঠেছিলেন আমার পিতামহ। টু-ইন-ওয়ানটা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন আমার সামনে থেকে। প্রবল বকুনি খেয়েছিলাম। গর্জে উঠে বলেছিলেন, “গান বিকৃত করে শুনবে না একদম। কোনও দিন যেন এমন না দেখি ফের।” আমার পিতামহ বেঁচে গিয়েছেন। আমি আজও রাগসঙ্গীতের আলাপ টপকে ঝালায় যাই। আলাপ বড্ড স্লো, বোরিং। ‘মিউচুয়াল-ফান্ড-ইনভেস্টমেন্টস-আর-সাবজেক্টেড-টু-মার্কেট-রিস্কস-রিড-অল-স্কিম-রিলেটেড-ডকুমেন্টস-কেয়ারফুলি’ নামক অজগরসম শব্দ তাঁকে দু’-তিন সেকেন্ডে শুনতে হয়নি। আমরা অনেক বদলে গিয়েছি, দাদান!
কেন এমন হাল হল আমাদের? ধৈর্য বলে বিষয়টা কি ক্রমশ খুঁজে নিচ্ছে নিরুদ্দেশের ঠিকানা? অবাক হয়ে দেখি, প্রত্যেকেই তাঁর নিজের মতো যুক্তি সাজাচ্ছেন। বলছেন, “গতিতেই মুক্তি!” ‘আমি কেন দ্বিগুণ স্পিডে সিনেমা দেখি’— এই নিয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ লিখেছেন বহু মানুষ। গতির ইতিহাস জানলে বিস্মিত হতে হয়। এক জন লিখেছেন, “তখন কোভিডকাল, বুঝলেন! ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কাজ করতাম, আর অবসর সময়ে ইউটিউবে রান্নার রেসিপি দেখে বানিয়ে ফেলতাম নিত্যনতুন পদ। ছোটবেলা থেকেই আমি রান্নার সমঝদার। এ বারে এটা দাও রে, এ বারে ওটা দাও রে, এত ক্ষণ ধরে ভাজো রে— এত কথা শোনার সময় আমার নেই। মোদ্দা কথা হল, নতুনত্ব কী আছে। ফলে বাড়িয়ে দিলাম স্পিড। সেই শুরু। মানুষ অভ্যাসের দাস। একই লজিক লাগিয়ে দিলাম সিনেমা দেখাতেও।”
অন্য একজন লিখেছেন, “শরীরচর্চা না করলে শরীর থাকবে? যোগব্যায়ামের ভিডিয়ো দেখতাম নিয়মিত। অত ইনিয়েবিনিয়ে শেখা পোষায় না। ভিডিয়োগুলো দ্রুত চালাতাম। স্টেপগুলো বুঝে নিতাম। তার পরে তো বাড়িতে প্র্যাকটিস। সিনেমা দেখাতেও ছড়িয়ে গেল এই লজিক। এতে অবশ্য ক্ষতি হয়নি কোনও। কম সময়ে অনেক বেশি মুভি দেখে ফেলছি আজকাল।”
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া এক ছাত্রের লেখায়, “অনলাইন ক্লাসে শিক্ষকের বকবক শুনে কাজ নেই। দেখতে হয় বোর্ডে উনি কী লিখছেন, সমীকরণগুলো কী ভাবে ভাঙছেন, অঙ্কগুলোর সমাধান কী ভাবে করছেন। ওঁদের হাতের লেখার স্পিডের সঙ্গে আমি তাল মেলাব কেন? ফলে ভিডিয়োর গতি বাড়িয়ে দিয়েছি তিনগুণ। দিব্যি ঢুকছে মাথায়। ওহে নর্মাল স্পিড, তুমি তো অস্তাচলে গিয়েছ কবেই। আজকাল সিনেমাও দেখছি এমন করে। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। টাইম ইজ় প্রেশাস।”
শুধুমাত্র একটি ফ্রেম কেমন হবে, তা নিয়ে যে পরিচালকরা ক্রমাগত নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছেন, তাঁদের কাছে এমন তথ্য উগরে দিয়ে, নিজের দু’কান ধরে মতামত জানতে ইচ্ছে করে। আলফ্রেড হিচকক বলেছিলেন, “সিনেমায় গল্প বলার সময় সংলাপের দ্বারস্থ তখনই হতে হয় যখন একে এড়িয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব।” বিশ্ববন্দিত বহু পরিচালকের মূল মন্ত্র ছিল ভিসুয়ালস। এমন অনেক সোনালি ফ্রেম মাথার সার্কিট বোর্ডে গেঁথে আছে। নাকে যত দিন অক্সিজেন ঢুকবে, গেঁথে থাকবে। অন্য একটি ব্লগ বলছে, “কনটেন্টের জন্য অ্যাপগুলোকে পয়সা দিচ্ছি মশাই। যত পারি, নিংড়ে নেব। ফ্রেম দেখে কাজ নেই। আসল কথা, কনটেন্ট। আমার সিনেমা দেখার সংবিধানে চলচ্চিত্রের ফ্রেম, কনটেন্টের মধ্যে পড়ে না। সংলাপ শুনব না। সাবটাইটল পড়ে নেব ঝড়ের মতো।” এক পরিচিত মনোবিদ এ প্রসঙ্গে জানালেন, স্তব্ধতার সঙ্গে এ প্রজন্মের লোকজনদের আড়ি হয়ে গিয়েছে পাকাপাকি ভাবে। জিঙ্গালালা জীবনে এক মিনিট ধরে চোখের ভাষা পড়ার মতো সময় নেই কারও এখন। আর এই সময় না থাকার বিষয়টা হল আত্মতৃপ্তি। না ছুটলে এরা অসুস্থ
হয়ে পড়ে।
গতি বাড়ানোর মতির সন্ধান করতে গিয়ে জানতে পারা গেল আরও অদ্ভুত কিছু পরিসংখ্যান। আমাদের মস্তিষ্ক নাকি মিনিটে ২৭৫টি শব্দ ‘প্রসেস’ করার জন্য প্রস্তুত! ‘প্রসেস’ বলতে বোঝানো হচ্ছে, শব্দগুলো শুনে তার মানে বুঝে নেওয়ার ক্ষমতার কথা। সাধারণ কথোপকথনে শব্দের সীমা মিনিটে ১৬০টির বেশি ছাড়ায় না। সিনেমার গতি দ্বিগুণ করে দিলে ক্ষুধার্ত, বুভুক্ষু মাথার এই চাহিদা মেটে! যাঁরা দ্বিগুণ স্পিডে সিনেমা দেখেন, মগজে শান দেওয়াতে তাঁরা ক্রমশ আরও বুদ্ধিমান হয়ে পড়ছেন কি না তা নিয়ে হয়তো গবেষণা হবে কখনও।
খ্যাতনামা এক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জানিয়েছে, ২০২২ সালে তাদের ৩৫ শতাংশ সাবস্ক্রাইবার দ্বিগুণ গতিতে সিনেমা দেখেছেন। বলাই বাহুল্য, এখন আবার হিসাব নেওয়া হলে এই গতিপ্রেমীদের শতাংশ আরও বাড়বে। হাল আমলে দ্বিগুণ স্পিড ‘নিউ নর্মাল’। কোনও কোনও মিডিয়া প্লেয়ার ১৬ গুণ পর্যন্ত গতি বাড়িয়ে দিতে পারে। অনেকে সে ভাবেও দেখছেন। গতির চাহিদাই তো গতি বাড়ানোর অপশনের জন্ম দেয়।
দেখার চোখ বদলে গেলে কেমন হবে আগামী দিনের সিনেমা? আন্তর্জাল বলছে, সিনেমার গতিপ্রকৃতি বুঝে নিজেই স্পিড ঠিক করে দেবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মধ্যে পুরে দেওয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সংলাপহীন দৃশ্যের গতি বেড়ে যাবে স্বয়ংক্রিয় ভাবে। নিভৃত প্রেমপর্বের গতি কমেও যেতে পারে হঠাৎ, দর্শকের মস্তি-বৃদ্ধি করার জন্য! মূল সিনেমার দৈর্ঘ্য যাই হোক না কেন, কত মিনিটের মধ্যে দেখে নিতে চাই জানিয়ে দিলে সে ভাবেই তাকে সাজিয়ে দেবে এআই। আরও জানা গেল, এর ফলে কিছু পরিচালকের হয়তো গোঁসা হতে পারে। তাঁরা চালু করে দেবেন নয়া ফরমান—ডিরেক্টর’স স্পিড লক। মানে পরিচালকের নির্দিষ্ট করা স্পিডেই দেখতে হবে গোটা সিনেমা। কোনও ভাবেই খোদার উপরে খোদকারি করা চলবে না।
প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে না থাকতে পেরে তাঁরা হয়তো হারিয়ে যাবেন ১৬এক্স স্পিডে।
কে জানে!