উচ্চবর্ণের ভোট হারানোর আশঙ্কায় কংগ্রেস নেতৃত্ব
প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি, ৩ মে: নরেন্দ্র মোদীর ওবিসি ভোটব্যাঙ্কে ধস নামাতে কংগ্রেস ৫০ শতাংশের সংরক্ষণের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এর ফলে চাকরি, শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’-র জন্য আসন কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে এই ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’ বা উচ্চবর্ণের ক্ষোভের মুখে পড়তে হতে পারে বলে কংগ্রেস নেতৃত্বের আশঙ্কা রয়েছে। তা কী করে সামলানো হবে, তার কোনও উত্তর এখনও কংগ্রেসের কাছে নেই। জাতীয় কংগ্রেসের এক সাধারণ সম্পাদক বলেন, “উচ্চবর্ণের ক্ষোভ তৈরি হলে তা সামলাতে হবে। তবে ওবিসি ভোটব্যাঙ্ককে পাখির চোখ করতে গিয়ে উচ্চবর্ণের ভোট হারানোর আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।”
বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সরকার মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করে ওবিসি বা অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ২৭ শতাংশ আসন সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ হয়েছিল। জেনারেল ক্যাটেগরি-র পড়ুয়াদের ক্ষোভ ছিল, মেধার ভিত্তিতে চাকরি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢোকার সুযোগ কমে যাচ্ছে। রাহুল গান্ধী জাতগণনার সঙ্গে ওবিসি-দের জনসংখ্যায় ভাগ অনুযায়ী সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন। ওবিসি-দের জনসংখ্যায় ভাগ ৫০ শতাংশের বেশি বলে অনুমান। সেই অনুযায়ী ওবিসি-দের জন্য আসন সংরক্ষণ বাড়াতে হলে মোট সংরক্ষিত আসন বাড়াতে হবে। রাহুল গান্ধী ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে জেনারেল ক্যাটেগরি বা তথাকথিত উচ্চবর্ণের জন্য আসন কমে যাবে।
কংগ্রেসের একটি সূত্রের বক্তব্য, ইউপিএ সরকারের মধ্যেও জাতগণনার ফলে উচ্চবর্ণের ক্ষোভ নিয়ে ভয় ছিল। মনমোহন সিংহের আমলে সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি-র চাপে সরকার জাতগণনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, জনগণনার সময় তফসিলি জাতি, জনজাতির সঙ্গে ওবিসি-দের সংখ্যাও গোনা হবে। কিন্তু সে সময় পি চিদম্বরম, প্রণব মুখোপাধ্যায়, এ কে অ্যান্টনির মতো কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা এ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে অ্যান্টনি বলেছিলেন, জাতগণনা হলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বণিক সম্প্রদায়ের মতো উচ্চবর্ণ অসন্তুষ্ট হবে। জাতগণনা না হলে ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক অসন্তুষ্ট হবে। শেষ পর্যন্ত রেজিস্ট্রার জেনারেলকে দিয়ে জাতগণনার বদলে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রককে দিয়ে আর্থ-সামাজিক ও জাতগণনার কাজ করানো হয়।
কংগ্রেসের এক শীর্ষনেতার ব্যাখ্যা, নরেন্দ্র মোদীর আমলে হিন্দি বলয়ে সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি-র চিরাচরিত ভোটব্যাঙ্ক ওবিসি-র একটা বড় অংশ বিজেপির দিকে সরে গিয়েছে। বিজেপি মোদীর ওবিসি পরিচিতিকে কাজে লাগিয়েছে। তার সঙ্গে বরাবরই উচ্চবর্ণের বড় অংশের ভোট বিজেপির দিকে যায়। রাহুল গান্ধী লোকসভা নির্বাচনে সংবিধান বাঁচানোর স্লোগানের সঙ্গে জাতগণনার দাবি তুলেছিলেন। অখিলেশ যাদব ‘পিছড়ে, দলিত, অল্পসংখ্যক’-এর কথা বলেছিলেন। তার ফলে বিজেপির থেকে দলিত, ওবিসি ভোট কিছুটা সরে যায়। বিজেপির আসন কমে যায়। এখন বিজেপি বিহারের ভোটের আগে সেই কারণেই রণনীতি শুধরে জাতগণনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কাল ফের বিহারে যাচ্ছেন। উল্টো দিকে আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব আজই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে দাবি তুলেছেন, বিহারের জাতগণনায় দেখা গিয়েছিল, অনগ্রসর ও অতি অনগ্রসরদের জনসংখ্যার ভাগ ৬৩ শতাংশ। জাতীয় স্তরেও এই ছবি দেখা গেলে সেই অনুযায়ী সংরক্ষণের সীমা বাড়াতে হবে। ৫০ শতাংশের বেশি আসন সংরক্ষণ করা যাবে না বলে কৃত্রিম ঊর্ধ্বসীমা তুলে নিতে হবে।
এক সময় মণ্ডল রাজনীতির মোকাবিলায় হিন্দু ভোট এককাট্টা রাখতে বিজেপি-আরএসএস কমণ্ডলের রাজনীতি শুরু করেছিল। এখন সেই বিজেপি-আরএসএস আবার কমণ্ডল থেকে মণ্ডল রাজনীতিতে ফিরছে। তার সঙ্গে টেক্কা দিতে গিয়ে কংগ্রেস সংরক্ষিত আসনের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর দাবি তুললে উচ্চবর্ণের ভোট পাকাপাকি ভাবে কংগ্রেসের থেকে সরে যেতে পারে বলে দলের অন্দরেই আশঙ্কা।
কংগ্রেসের অন্য এক নেতার যুক্তি, এমনিতেই হিন্দি বলয়ে উচ্চবর্ণের মানুষ কংগ্রেসকে ভোট দেন না। তা ছাড়া কংগ্রেস এখন ক্ষমতাতেই নেই। বিরোধী শিবির থেকে রাহুল গান্ধী ৫০ শতাংশের সংরক্ষণের ঊর্ধ্বসীমা সরানোর দাবি তুলে মোদী সরকারকে চাপে ফেলতে চাইছেন। আগে মোদী সরকার এর ঠেলা সামলাক। কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় আসবে, তখন উচ্চবর্ণের ক্ষোভ নিয়ে ভাবা যাবে।