আন্দ্রে রাসেল রবিবাসরীয় ইডেনে শুধু পুরনো রাসেলকেই ফিরিয়ে আনলেন না। শুধু কেকেআরের মৃতপ্রায় আইপিএল অভিযানকে বুস্টার ডোজ় দিয়ে বাঁচিয়েই তুললেন না। একই সঙ্গে নতুন টি-টোয়েন্টি লিগের লোভনীয় চুক্তিও জিতে ফেললেন। এই ৩৭-এর বুড়িয়ে আসা রাসেলকে নেওয়ার জন্যও যে এমন প্রবল আগ্রহ কেউ দেখাতে পারে, কে জানত!
আরও চমকপ্রদ, যিনি রাসেলের দিকে নতুন এই চুক্তিপত্র বাড়িয়ে দিলেন। তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়—ঘাপটি মেরে স্পটার হিসেবে ক্লাব হাউজ়ের বক্সে বসে ছিলেন, কেউ বিশ্বাস করবে! প্রাক্তন কেকেআর অধিনায়ক এখন দিল্লি ক্যাপিটালসের সঙ্গে যুক্ত। আইপিএলের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি লিগে দল রয়েছে জেএসডব্লিউ গ্রুপের। সেই দলের নাম প্রিটোরিয়া ক্যাপিটালস। যারা প্রথম বারে এসএ-২০ লিগে রানার্স। রাসেলকে এই প্রিটোরিয়া ক্যাপিটালসের হয়ে আসন্ন মরসুমে খেলাতে চান সৌরভ।
রবিবার রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে রাজস্থান রয়্যালসকে ১ রানে হারায় কলকাতা নাইট রাইডার্স। এ দিকে রাস-লীলা তো ও দিকে রিয়ান-ঝড়। পর-পর ছয় বলে ছয় ছক্কা আজ পর্যন্ত আইপিএলে কেউ মারেনি। রিয়ান তাই করে দেখালেন। পাঁচ বলে পাঁচ ছক্কা এর আগে হয়েছে। ২০১২-তে পুণে ওয়ারিয়র্সের বিরুদ্ধে রাহুল শর্মার পাঁচ বলে পাঁচ ছক্কা মারেন ক্রিস গেল। ২০২৩-এ গুজরাত টাইটানসের বিরুদ্ধে পাঁচ বলে পাঁচ ছক্কা মেরে নাইটদের জেতান রিঙ্কু সিংহ। আইপিএলে কোনও ব্যাটসম্যানের পর-পর ছয় বলে ছয় ছক্কা এই প্রথম।
তবে গ্যারি সোবার্স, রবি শাস্ত্রী বা যুবরাজ সিংহদের মতো এক ওভারে ছয় ছক্কা নয়। রিয়ান প্রথমে মইন আলির শেষ পাঁচ বলে পাঁচটি ছক্কা মারেন। তার পরের ওভারে বরুণের প্রথম যে বলটি তিনি খেলেন, তাতে রিভার্স সুইপে ছক্কা মারেন। তাতেই খেলা পুরো একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে রাজস্থানের দিকে ঢলে পড়েছিল। নাটকীয় শেষ ওভারে কেকেআর শেষ বলে জেতে ১ রানে।
তার পরেই মাঠে গিয়ে রাসেলের সঙ্গে কথা বলেন সৌরভ। কী কথা হল দু’জনে? সৌরভ প্রথমেই রাসেলকে অভিনন্দন জানান দুর্ধর্ষ ইনিংসের জন্য। রাসেলকেও দেখা যায়, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। একটা সময় মনে হল, হাত জোড় করে কিছু বলছেন। এর পরেই তাঁর পরিকল্পনার কথা জানান সৌরভ। রাসেলকে বলেন, তোমাকে আমাদের প্রিটোরিয়া ক্যাপিটালস দলে খেলাতে চাই। জানা গিয়েছে, রাসেল খেলতে রাজিও হয়েছেন। ক্যারিবিয়ান লিগে কেকেআরের দল আছে, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টি লিগে তারা খেলে না। তাই রাসেলকে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মের দিক থেকে অসুবিধা নেই প্রিটোরিয়া ক্যাপিটালসের। ইডেন থেকে বেরোনোর সময় সৌরভকে বেশ আশাবাদী শোনাল রাসেলকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়ার ব্যাপারে।
মাঠে তখন কেকেআরের বিজয়োৎসব চলছে। শাহরুখ খান উদ্বোধনী ম্যাচের পরে আর আসেননি। কিন্তু জুহি চাওলা ছিলেন। তিনি মাঠে নেমে এসে রাসেল, নারাইনদের অভিনন্দন জানাতে থাকলেন। ডিজে জোরে বাজিয়ে দিয়েছেন ‘করব, লড়ব, জিতব রে’। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যেন নিভে আসা প্রদীপ আবার জ্বলে উঠেছে। প্লে-অফে যেতে হলে শেষ চারটে ম্যাচের চারটেতেই জিততে হবে, এটা ছিল প্রথম শর্ত। তার পর দেখতে হবে, অন্যান্য দলগুলির অবস্থা। অন্তত প্রথম বাধাটা পেরোনো গেল। রাতের ম্যাচে পঞ্জাব কিংস হেলায় জিতে দু’নম্বরে উঠে এসেছে। প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে পয়েন্ট টেবল। কেকেআর এখনও ছয় নম্বরে। প্লে-অফের চার দল হওয়ার দৌড়ে এখনও ফেভারিট মুম্বই ইন্ডিয়ানস, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু, গুজরাত টাইটানস ও শ্রেয়স আয়ারের পঞ্জাব কিংস। কিন্তু কেকেআর যদি বাকি তিন ম্যাচ জিততে পারে, শেষ করবে ১৭ পয়েন্টে। তখন দরজা খুলতেও পারে।
কী দুর্ধর্ষ সব মোচড় আর অপ্রত্যাশিত বাঁক দেখা গেল রবিবারের ম্যাচে। কেকেআর খুব মন্থর শুরু করল। রাসেলের আগমনটা মনে করার চেষ্টা করুন। ভীষণ মন্থর ভাবে শুরু করেছিলেন। প্রথম ৯ বলে করলেন ২। তার পরের ১৬ বলে ৫৫। সব মিলিয়ে ২৫ বলে ৫৭ অপরাজিত। চারটি চার ও ছ’টি পেল্লাই ছক্কা সমেত। স্ট্রাইক রেট ২২৮। আঠারোতম ওভারে মহেশ তিক্ষণকে পর-পর তিনটি ছক্কা মারলেন। নাইট রাইডার্স ১৫ ওভার শেষে ছিল ১২১-৩। সেখান থেকে শেষ করল ২০৬-৪ নিয়ে। রাসেল আর রিঙ্কুকে কেন এত পরে নামানো হচ্ছে, তা নিয়ে বারবার কথা উঠেছে। এ দিন হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে গেল, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতদের ‘পাণ্ডিত্য’-ই পুরো ভুল ছিল। রাসেল নিজেও তো খোঁচা দিয়ে গেলেন নাইট ম্যানেজমেন্টকে। বিরতিতে সম্প্রচারক চ্যানেলের সামনে পরিষ্কার বলে দিয়ে গেলেন, ‘‘যত বেশি বল পাব, তত বেশি আমি অবদান রাখতে পারব।’’ এর চেয়ে খোলাখুলি মনের উষ্মা আর কী ভাবে প্রকাশ করবেন? রিঙ্কু সিংহকে জিজ্ঞেস করলেও বোধ হয় একই কথা বলতেন যে, আপনারা অঙ্গকৃশ, রামনদীপদের উপরে পাঠাচ্ছেন। আমি কী দোষ করলাম? এ দিন রাসেল যদি ম্যাচের সেরা হন, তা হলে যোগ্য সঙ্গতের জন্য রিঙ্কুকে অন্তত নাইট ড্রেসিংরুমে পুরস্কৃত করা উচিত। ৬ বলে ১৯। শেষ পাঁচ ওভারে কেকেআর তোলে ৮৫। এর মধ্যে শেষ তিন ওভারে ওঠে ৫৭। শেষ ওভারে ২২। রিঙ্কু দু’টো পর-পর ছক্কা মেরে ২০০ পার করলেন। এর পরেও কে ভেবেছিল, রাজস্থান রয়্যালস ম্যাচটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে! হাসরঙ্গ যখন আউট হলেন রাজস্থান রয়্যালস ৭১-৫। বৈভব সূর্যবংশী ফিরে গিয়েছেন। বিস্ময় কিশোরের এই প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ইডেনে আত্মপ্রকাশ। ক্লাব হাউজ়ের আপার টিয়ারে দেখলাম, রাজস্থানের ইনিংসের শুরু হচ্ছে দেখে অনেকে সিটে গিয়ে বসে পড়লেন। বাচ্চাটার ইনিংস দেখতে হবে। রান পেলেন না ঠিকই কিন্তু বোঝা গেল, ভারতীয় ক্রিকেট আকাশে নতুন তারার উদয় ঘটে গিয়েছে। এমন আগ্রহ শেষ কবে চোদ্দো বছরের কাউকে নিয়ে দেখা গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত বিহারে গিয়ে বৈভবের নাম নিচ্ছেন! যতই বলি তুলনা টানব না, সেই সারদাশ্রম স্কুল আর ঝাঁকড়া চুলের বিস্ময় বালকের কথা মনে পড়ে যাবেই। ৩৫ বলে শতরান করে আসা বৈভব আউট। যশস্বী জয়সওয়াল বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলেন। তিনিও ফিরে গিয়েছেন। আর কে জেতাবে রাজস্থানকে? ৭৩ বলে চাই ১৩৬। ম্যাচ শেষ ধরে নিয়েছে গোটা ইডেন। অনেকে বাড়ি চলে যাবেন কি না ভাবছেন। কোথা থেকে হঠাৎ উদয় হলেন রিয়ান পরাগ। মইন আলির ওভারে পাঁচ ছক্কা মেরে নিলেন ৩২। বিস্মিত হয়ে ইডেন ভাবছে, আজও কি শনি নাচছে কপালে? পঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে ১১১ তুলতে গিয়ে হেরেছে। এই ইডেনে লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধে জেতা ম্যাচ দিয়ে এসেছে। এ বার ধ্বংসকারীর নাম কি রিয়ান পরাগ?
ভাবতে না ভাবতেই নতুন মোড়। হর্ষিত রানা প্রথম দুই ওভারে দিয়েছিলেন ২৮। চলতি আইপিএলে একেবারেই ছন্দে নেই। শিমরন হেটমায়ার এবং রিয়ান পরাগ— দুই কাঁটাই সরালেন হর্ষিত। ক্রিকেট কখন কাকে রাজা বানায়, কখন কাকে ফকির কে বলতে পারে! কিন্তু তাতেও নাটক শেষ হল না। শুভম দুবে যে রিয়ান পরাগ পার্ট টু হয়ে উঠতে পারেন, কে ভেবেছিল। শেষ ওভারে চাই ২২। বৈভব অরোরাকে একটা চার, দু’টো ছক্কা মেরে দিলেন শুভম। শেষ বলে চাই ৩। কোনও রকমে ২ নিতে পারলেই সুপার ওভার। বৈভব দারুণ নিশানায় ইয়র্কার করলেন। খেলেই দৌড়লেন শুভম। কুঁচকির চোট নিয়ে দুর্দান্ত থ্রো করলেন রিঙ্কু সিংহ। তার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিশ্চিত বাউন্ডারি বাঁচিয়েছেন। তখনই চোট লাগে। ওই চারটা না আটকালে বিজয়োৎসবের দৃশ্য তৈরি হত কি না সন্দেহ। রিঙ্কুর থ্রোতে রান আউট জফ্রা আর্চার। ১ রানে জিতে ভেসে থাকল কেকেআর। ব্যাটের পাশাপাশি বোলার রাসেলের কথাও বলতে হবে। ১৯তম ওভারে দিলেন মাত্র ১১ রান।
সৌরভ আর দেরি করেননি। পাকা কথা সেরে নিলেন। কয়েক দিন ধরেই ভাবছিলেন, রাসেলকে দক্ষিণ আফ্রিকার লিগের জন্য সই করাবেন। বিশ্বাস ছিল, আর একটু বেশি বল খেলতে দিলে রাসেল এখনও জেতাবেন। রবিবারের ইডেন দেখিয়ে দিল, সৌরভ ভুল ভাবেননি। আর এটাও বুঝিয়ে দিল, আইপিএলে এখনও ক্যারিবিয়ান পেশিশক্তির কোনও বিকল্প নেই। শনিবার বেঙ্গালুরুর হয়ে ঝড় তুলেছিলেন রোমারিয়ো শেফার্ড। এ দিন ইডেনে দ্রে রাস। ক্রিস গেল যদি ‘ইউনিভার্স বস’ হন, আন্দ্রে রাসেল এখনও
‘কলকাতা বস’।