সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকায় দু’টি খবর বেরিয়েছিল, সপ্তাহখানেক আগে-পিছে। তামিলনাড়ুতে এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করেছিলেন, কারণ স্ত্রী অবসর সময়ে পর্ন দেখেন এবং স্ব-মেহন করেন। দ্বিতীয় খবরটি কেরলের। কোচির ৯১ বছরের এক বৃদ্ধ তাঁর ৮৮ বছরের স্ত্রীকে গার্হস্থ বচসার জেরে আঘাত করেন, যাতে মহিলা মারাত্মক জখম হন। মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতি জি আর স্বামীনাথন এবং বিচারপতি আর পূর্ণিমা বলেছেন, আইন লঙ্ঘন না করে পর্ন দেখা নিষ্ঠুরতা বলে গণ্য হতে পারে না, বিবাহবিচ্ছেদের কারণ তো হতেই পারে না। ব্যক্তি পরিসরের অধিকার মৌলিক অধিকার। নারীর যৌন স্বাধিকার এবং ব্যক্তিগত পরিসরের অধিকার, দুটোই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী কিংবা স্ত্রীর ব্যক্তিপরিসরও এই পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় ঘটনাটিতে কেরল হাই কোর্টের বিচারপতি পি ভি কুনহিকৃষ্ণন বলেছেন, বয়স হলে স্বামী এবং স্ত্রীর পারস্পরিক নির্ভরতা বাড়ে। সে কথা মাথায় রেখে এই অশীতিপর দম্পতির উচিত পরস্পরকে অবলম্বন করে ভালবাসার আলোয় বাকি জীবন কাটানো। নিঃসন্দেহে দু’টি ক্ষেত্রেই কোর্টের রায় আশাব্যঞ্জক। কিন্তু দাম্পত্যের কালো চশমার আড়ালে যা এখানে দৃশ্যমান হয় না, তা হল পিতৃতন্ত্রের বিষাক্ত ছায়া, যা নারীর স্বাধিকারকে জীবনের প্রত্যেক স্তরে অস্বীকার করে। কোনও অশীতিপর দম্পতির ক্ষেত্রেও পুরুষ সঙ্গীটিকে সাহস জোগায় বৃদ্ধা স্ত্রীকে শারীরিক আঘাত করতে। ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স বা ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা হিংসার ছবি ফুটে ওঠে পরতে পরতে।
বীরভূম বা ঝাড়খণ্ডের প্রান্তিক গ্রামগুলোতে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, অধিকাংশ বিবাহিতা মহিলা প্রতি দিন স্বামীর হাতে মার খান। সমাজ একে এতটাই ‘স্বাভাবিক’ করে তুলেছে যে, অনেকে সত্যিই বিশ্বাস করেন, বরের মার না খেলে খাবার হজম হবে না। মেয়ে হয়ে জন্মে মার তো খেতেই হবে। স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ে এই ধারণাই প্রচলিত এবং গৃহীত। স্ব-মেহনের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইচ্ছেও যে-হেতু মেয়েদের স্বাধিকারের ইঙ্গিত দেয়, তাই তার বিরুদ্ধে আদালতেও নালিশ করা যায়। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অধিকার নিয়ে আলোচনার সুযোগই হয় না। অথচ পুরুষের স্ব-মেহন সর্বজনবিদিত ও গ্রাহ্য। পুরুষ-সঙ্গীই ঠিক করেন যৌন সংসর্গ কখন হবে, কেমন হবে এবং সন্তান কখন কখন জন্মাবে। ক্লান্তি বা অসুস্থতার জন্য যৌন সম্পর্কে ‘না’ বলার অধিকার মেয়েদের নেই। নিজের অধিকারের কথা মেয়েরা সামান্য তুললেও মেরে রক্তপাত ঘটাতে দ্বিধা করেন না জীবনসঙ্গীরা।
পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২১) বলছে, এ দেশে যে মেয়েরা বিবাহিত, বা কোনও সময় বিবাহিত ছিলেন, তাঁদের ২৯ শতাংশ স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের মতো দেশে ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা হিংসার ঘটনা নারী-হিংসার সব ঘটনার ২৬ শতাংশ। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে তা প্রশাসনকে জানানো হয় না। যে সব মহিলার শিক্ষাগত যোগ্যতা, চাকরি বা রোজগার স্বামীর থেকে বেশি, তাঁরা বার বার স্বামীর মারধরের শিকার হচ্ছেন। অনেকেই মনে করেন যে গার্হস্থ হিংসা মানে তো জায়ে জায়ে ঝগড়া, শাশুড়ি বৌমার আকচা-আকচি বা স্বামী-স্ত্রীর অবনিবনা, যা লুকিয়ে চলাই প্রতিটি মেয়ের কর্তব্য। সন্তানকে উৎকট শাসন ও মারধরও কিন্তু গার্হস্থ হিংসার মধ্যে পড়ে। শুধুমাত্র স্বামী কিংবা ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা প্রহৃত বা নিগৃহীত হলেই হিংসার আওতায় পড়ে। মেয়েরা এগুলিকে আলাদা করে ‘অপরাধ’ বলে চিহ্নিত করে না। বরং দাগিয়ে দেওয়া হয় স্বামীর ‘শাসনের অধিকার’ বলে।
মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত-সহ এ দেশের অনেক রাজ্যে স্কুলে যৌনতার পাঠ (সেক্স এডুকেশন) নিষিদ্ধ। বড় জোর ‘বয়ঃসন্ধি শিক্ষা’ (অ্যাডলেসেন্ট এডুকেশন) শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হতে পারে। ২০১৮ সালে ইউনেস্কো দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সেক্স এডুকেশন-এর একটি গাইডলাইন পেশ করে। তার পরেও খুব একটা কাজ হয়নি। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের সতেরোটি রাজ্যের ৭১ শতাংশ কিশোর ও যুবক (বয়স ১৩ বছর থেকে ৩০ বছর) বলছেন, স্কুল-শিক্ষক বা মা-বাবা, কারও কাছ থেকেই তাঁরা যৌনতা বিষয়ক কোনও শিক্ষা পাননি। ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যরক্ষা বা ব্যক্তিগত সঙ্গীর হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, কোনওটাই মহিলারা পেরে ওঠেন না। ভুক্তভোগী সমাজের প্রতিটি স্তর।
বোধ হয় সময় এসেছে চোখের ও মনের ঠুলি সরিয়ে এই বিষয়গুলিতে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা শুরু করার। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় যাঁরা কাজ করছেন, নিয়মিত সচেতনতা শিবির করে যেখানে গার্হস্থ হিংসা, লিঙ্গ-অসাম্য প্রভৃতি আলোচিত হচ্ছে, সেখানে এমন ভাবে এই বিষয়গুলি নিয়ে আসতে হবে, যাতে সব মেয়ের কাছে তা অর্থপূর্ণ হয়। সেই তালিকায় প্রথমেই থাকবে মেয়েদের যৌন-স্বাস্থ্য ও যৌনতায় স্বাধিকার রক্ষা, এবং ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা হিংসার প্রতিরোধ। এমন অনেক জরুরি বিষয় রয়েছে। বোঝার সময় এসেছে যে, সেক্স এডুকেশন মানে যৌনতার চর্চা নয়, বরং যৌন ও প্রজননতন্ত্র, তার স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট অধিকারগুলি জেনে নেওয়া। যা মেয়ে ও পুরুষ, সকলের মধ্যে একই সঙ্গে লিঙ্গ সাম্যের ধারণা দেবে এবং একটি সাম্যময়, ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। এমন একটি সম্মিলিত আত্মদর্শন গড়ে তুলতে আমরা প্রত্যেকে দায়বদ্ধ।