যোগ্য উপায়
‘২৫,৭৫৩ জনের চাকরি বাতিলে বলি যোগ্যরাও’ (৪-৪) শীর্ষক সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। এ বছরের ৩ এপ্রিল তারিখটা নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটা ‘কালো’ দিন হিসেবেই চিহ্নিত হবে। নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে এক সঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের নির্দেশ আগে কোনও দিন দেশে ঘটেনি।
কলকাতা হাই কোর্টের আগের নির্দেশ বহাল রেখে শীর্ষ আদালত যে রায় দিয়েছে, তার দুটো দিক রয়েছে। এক দিকে, প্রশাসনিক দুর্নীতির শিকার হলেন বেশ কিছু নিরীহ প্রার্থী, অন্য দিকে অযোগ্যরা তাঁদের কৃতকর্মের জন্য যথোপযুক্ত ভাবে শাস্তি পেলেন। শেষোক্ত প্রার্থীর সংখ্যা ৬,২৭৬ জন, যাঁরা জালিয়াতি, প্রতারণা করে চাকরি পেয়েছেন। শীর্ষ আদালত তার রায়ে এটাও জানিয়েছে, নিয়োগে অনিয়মের তথ্য ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও স্কুল সার্ভিস কমিশন তার খামতি ও অনিয়মগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছে। এই ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টার ফলে (যোগ্য-অযোগ্যদের) যাচাই এবং চিহ্নিত করা আরও কঠিন কাজ হয়ে পড়েছে। কিন্তু, একই সঙ্গে, শাস্তি প্রয়োগ বা শাস্তি ছাড়ের ক্ষেত্রে তারা আবার দুটো ভাগও করেছে। প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এক দিকে উল্লিখিত ‘অযোগ্য’দের জন্য পুরো বেতন সুদ-সহ ফেরত দেওয়ার নির্দেশের সঙ্গে শূন্যপদ পূরণের নিয়োগে তাঁরা যোগ দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছে। অপর দিকে, বাকিদের এই শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়া ছাড়াও পুরনো চাকরির জন্য আবেদন করার অনুমতিও আদালত দিয়েছে।
আমাদের বিচারব্যবস্থার মূল কথা— কোনও অভিযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড় পেয়ে গেলেও কোনও নির্দোষ যেন কখনও শাস্তি না পায়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রে উপরোক্ত শাস্তির জন্য চিহ্নিত ওই ‘অযোগ্য’দের বাদ দিয়ে অন্য অযোগ্যদের যদি প্রমাণের অভাবে আদালত ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিয়ে থাকে, তা হলে বলব তারা ঠিক কাজই করেছে। তবে, প্ৰকৃত ‘যোগ্য’দের জন্য চাকরি বাতিলের যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তার প্রভাবটা যদি কিছুটা কমানো সম্ভব হত, তা হলে মনে হয় তাঁদের প্রতি কিছুটা ‘সুবিচার’ করা যেত।
যাঁদের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতি’র কোনও অভিযোগ নেই, বয়সের ক্ষেত্রে ছাড়ের সুবিধে নিয়ে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাঁদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া, এবং চাকরি পাওয়ার কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন তাঁরা যাতে না হন, সেই ব্যবস্থা করা— এগুলি যদি মহামান্য আদালতের বিচার-বিবেচনায় থাকে, তা হলে ভাল হয়।
মানবিক কারণেই, এক বারের জন্য অন্তত ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের সাফল্যে পৌঁছনোর রাস্তাটা কিছুটা সুগম করে দেওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি।
গৌতম নারায়ণ দেব
কলকাতা-৭৪
কঠিন পদক্ষেপ
গত বছর এপ্রিল মাসে কলকাতা হাই কোর্ট ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োজিত শিক্ষক, অ-শিক্ষক কর্মীদের যে প্যানেলকে বাতিল করেছিল, তাতে কিছু পরিমার্জন করে সেই রায়কেই বহাল রাখল সর্বোচ্চ আদালত। এক সঙ্গে চলে গেল ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি। প্যানেলের হিসাব অনুযায়ী যেখানে ৬,২৭৬ জন অনৈতিক ভাবে চাকরি কিনেছিলেন, সেখানে গোটা প্যানেল বাতিল করে দেওয়া মানে বর্তমান সময়ের নিরিখে একটা গোটা প্রজন্মকে অন্ধকার দিকে ঠেলে দেওয়া। আদালতের এই রায় প্রকাশের পরেই রাজ্যের শাসক ও বিরোধী সব দলই আসরে নেমেছে। বিরোধীদের বক্তব্য, তাঁরা যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের পাশে থাকবেন এবং লড়াই চালিয়ে যাবেন। সেই সঙ্গে আদালতকে এই রায় নিয়ে যোগ্যদের স্বার্থে একটু সময় দেওয়ার আবেদন জানাবেন। অথচ, এই আবেদন আগে করলেও সম্পূর্ণ বিষয়টি বিশদে পুনর্মূল্যায়ন করা সম্ভব হত। অর্থাৎ, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি জড়িয়ে ছিল।
বাতিল হওয়া যোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই বা সকলেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নও করে এসেছেন। তাঁদের সেই অবদানকে কি আরও একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখা যেত না? মহামান্য আদালতের রায় শিরোধার্য মেনেও এ কথা বলা যায়, এই নিয়ে হয়তো আরও বিশদ মূল্যায়নের প্রয়োজন ছিল। উচ্চ আদালত এবং রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের উচিত, যে সকল নেতা, কর্মীর কারণে রাজ্যে এই কালো দিন ঘনিয়ে এসেছে, একটা প্রজন্ম দিশাহীন হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করা— তবেই বিনা দোষে যাঁরা লাঞ্ছিত হলেন, তাঁদের প্রতি ন্যায় করা হবে। যাঁরা হাজার হাজার যুবক-যুবতীর অক্লান্ত পরিশ্রমের গুরুত্ব বোঝেং না, রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও উদ্বিগ্ন হন না, তাঁদের বাঁচানো মানে রাজ্যের ভবিষ্যৎকে আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া। রাজ্যের হাল ফেরাতে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাবই পথ, যাতে আগামী দিনে কেউ বিপথে এগোতে সাহস না পায়।
শুভজিৎ বসাক
কলকাতা-৫০