শ্রীনগর, ৪ মে: ভারত সামরিক অভিযান চালালে পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারে পিছপা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিলেন রাশিয়ায় নিযুক্ত পাক রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ খালিদ জামিল। রাখঢাক না করেই তিনি বলেছেন, ‘‘যুদ্ধ হলে আমরা প্রচলিত ও পারমাণবিক শক্তি উভয়ই ব্যবহার করব।’’ দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের তিক্ত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আবহে নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে ভারত। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বৈসরন উপত্যকায় ঠান্ডা মাথায় হত্যার আগে পর্যটকদের ভিড়ে মিশে ছিল দু’জন স্থানীয় জঙ্গি। তারাই নাকি পর্যটকদের নিয়ে গিয়েছিল খাবারের স্টলে।
পহেলগামে গণহত্যার পর থেকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে একের পর এক কূটনৈতিক পদক্ষেপ করেছে নয়াদিল্লি। পহেলগামের ঘটনার প্রত্যাঘাতের জন্য সেনাবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। সীমান্তের ও-পারেও জোরকদমে চলছে ভারত অভিযান চালালে জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি। ভারতের বিরুদ্ধে হুমকি-হুঁশিয়ারি দিয়ে চলেছেন পাক নেতা-মন্ত্রীরা। এ বার সেই তালিকায় নাম তুললেন পাক কূটনীতিক মুহাম্মদ খালিদ জামিল। রাশিয়ার একটি সংবাদমাধ্যমকে এক সাক্ষাৎকারে পাক রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘‘কিছু ফাঁস হওয়া নথি থেকে জানা গিয়েছে, ভারত পাকিস্তানের কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় হামলার পরিকল্পনা করছে এবং এই সংঘাত আসন্ন।’’ রীতিমতো হুমকির সুরে জামিল বলেন, ‘‘ভারত এবং পাকিস্তানের কথা বলতে গেলে, আমরা সংখ্যাগত শক্তির বিতর্কে জড়াতে চাই না। আমরা প্রচলিত এবং পারমাণবিক উভয় শক্তিই ব্যবহার করব। পাকিস্তানের জনগণের সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনী পূর্ণ শক্তির সঙ্গেই জবাব দেবে।’’ তাঁর মতে, দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রই যখন পরমাণু শক্তিধর, তখন তাদের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমন করা উচিত। তাঁর কথায়, ‘‘আমি মনে করি, এখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, চিন ও রাশিয়ার মতো পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি ওই তদন্তে অংশ নেবে।’’
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এবং অন্য গোয়েন্দা সংস্থার কাছে নাকি আগে থেকেই কাশ্মীরে সম্ভাব্য হামলার খবর ছিল। এপ্রিলে সেই হামলা হতে পারে, তা-ও জানতেন গোয়েন্দারা। খবর ছিল, ১৯ এপ্রিল, প্রধানমন্ত্রীর কাশ্মীর সফরের কাছাকাছি কোনও একটা দিনে শ্রীনগরে পর্যটকদের নিশানা করা হতে পারে। তার ভিত্তিতেই পদক্ষেপ করেছিল প্রশাসন। কিন্তু শ্রীনগরের পরিবর্তে হামলা হয় পহেলগামের বৈসরনে। পরে আরও জানা গিয়েছে, বৈসরনে পর্যটকদের ভিড়ে মিশে ছিল স্থানীয় দুই জঙ্গিও। এ ছাড়া, বাইরের আরও দুই জঙ্গি ছিল। চার জন মিলে পর্যটকদের উপর হামলা চালায়।
দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংঘাতের আবহে জম্মু ও কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি নজরদারি বাড়িয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে সেনা তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য ভাবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে আকাশপথ ও স্থলপথে। কুপওয়ারা, বারামুলা, পুঞ্চ এবং রাজৌরির মতো এলাকায় নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর মোতায়েন সেনাদের সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। উত্তর কাশ্মীরে কর্মরত এক প্রথম সারির সেনা অফিসার আনন্দবাজার পত্রিকাকে টেলিফোনে বলেছেন, ‘‘আমরা সীমান্তের ও-পারে তৎপরতা বাড়তে দেখছি। আমাদের সেনারা সতর্ক নজর রাখছে, এবং অনুপ্রবেশের চেষ্টাকে সফল হতে দেওয়া যাবে না।’’
দক্ষিণ কাশ্মীর, উত্তর কাশ্মীর এবং পীরপঞ্জাল অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় রাইফেলস, সিআরপিএফ এবং বিশেষ বাহিনীগুলি নিয়মিত তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। রাতের টহল, মোবাইল চেকপোস্ট এবং তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে যেখানে জঙ্গিরা আশ্রয় নিতে পারে বা পরিকাঠামোগত সহায়তা পেতে পারে। নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংলগ্ন অসামরিক এলাকায় আতঙ্ক ও উদ্বেগের পরিবেশ। অধিকাংশ গ্রামবাসী সন্ধ্যার পর নিজেদের চাষের খেতে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। উরি, টাংধার এবং হিরানগরের সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষজন জানিয়েছেন, রাতের বেলায় গুলির শব্দ ও সেনাবাহিনীর চলাচল এখন নতুন বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। উরির বাসিন্দা পেশায় কৃষক বশির আহমদের কথায়, ‘‘আমরা নিজেদের জীবনের জন্য আতঙ্কিত। আমাদের সন্তানেরা ভয়ে কাঁপছে। আমরা অন্ধকার নামার পর বাড়ির বাইরে যাই না।’’
২০১৯ সালের পর থেকে কাশ্মীর সীমান্তে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিন্তু পহেলগাম নাশকতার পরে তা অনেকটাই বেড়েছে। সেনা অফিসারদের ধারণা, সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের মূল কারণ পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসের কুশীলবদের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যাতে ভারতে ঢোকানোর কাজ সহজ হয়। ফলে নিরাপত্তায় কোনও রকম ফাঁক রাখতে চাইছে না সেনাবাহিনী। আকাশপথে এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলিতে আরও কঠোর করা হয়েছে নজরদারি। বিএসএফের এক সিনিয়র অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা নজরদারির জন্য আকাশপথে ড্রোনের ব্যবহার বাড়িয়েছি, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী বনাঞ্চলে যেগুলো প্রায়শই অনুপ্রবেশের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।’’