ফের ঐতিহ্য-ভ্রান্তি পুরসভার, গ্রেড ওয়ান মর্যাদাভুক্ত মন্দির শেষে দোকান!
দেবাশিস ঘড়াই
দোকান হয়ে গিয়েছিল ঐতিহ্যের নিরিখে গ্রেড-ওয়ান মর্যাদাভুক্ত মন্দির। আর ঐতিহ্যশালী মন্দির হয়ে গিয়েছিল নিছক এক দোকান। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এমনই চলে এসেছিল। ঠিকানা বিভ্রান্তির এই ঘটনা ঘটেছে কলকাতা পুর এলাকায়। শেষ পর্যন্ত সরেজমিনে পরিদর্শন করে সেই বিভ্রান্তি অবশ্য কাটিয়েছে পুর প্রশাসন। গ্রেড-ওয়ান মর্যাদাভুক্ত মন্দিরও নিজের যথাযথ ঠিকানা ফিরে পেয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত গত বছরের শেষে পুর কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে লেখা এক নাগরিকের চিঠিতে। চিঠিতে বলা হয়েছিল, কলকাতা পুরসভার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত ডাক্তার নারায়ণ রায় সরণিতে যে গোবিন্দ দে-র মন্দির রয়েছে, তার ঠিকানায় বিভ্রান্তি রয়েছে। পুরসভার হেরিটেজ তালিকা অনুসারে ওই মন্দিরের ঠিকানা হিসেবে নথিভুক্ত রয়েছে, ৭৪ ডাক্তার নারায়ণ রায় সরণি। কিন্তু আদতে ওই ঠিকানা হওয়ার কথা, ৭২ ডাক্তার নারায়ণ রায় সরণি। দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দুই ঠিকানার সম্পত্তিকরের বিলও দাখিল করেন আবেদনকারী। পুরসভার করের বিল অনুযায়ী, ৭২ নম্বর ঠিকানার মালিক হলেন ওই মন্দিরের দুই সেবায়েত। ৭৪ নম্বরের মালিক হলেন অন্য এক ব্যক্তি।
এই তথ্য পেয়ে নড়েচড়ে বসেন পুরসভার পরিবেশ ও ঐতিহ্য দফতরের আধিকারিকেরা। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পরিবেশ ও ঐতিহ্য এবং সম্পত্তিকর ও মূল্যায়ন দফতরের আধিকারিকদের একটি দল সরেজমিনে পরিদর্শনে যায়। গিয়ে দেখা যায়, পুরসভার তরফ থেকে মন্দিরের ঐতিহ্যের চিহ্নস্বরূপ একটি নীল ফলকও সেখানে লাগানো রয়েছে। কিন্তু তা লাগানো রয়েছে আবেদনকারীর কথা মতো ৭২ ডাক্তার নারায়ণ রায় সরণির ঠিকানায়। আর তার পাশেই পুর নথিতে উল্লিখিত ৭৪ নম্বরের ঠিকানায় রয়েছে একটি ছোট দোকান! মূল্যায়ন দফতরের নথি যাচাই করেও দেখা যায়, আবেদনকারী ঠিকই বলেছেন। কারণ, সেই নথিতেও ৭২ নম্বর ঠিকানাটিই নথিভুক্ত রয়েছে মন্দির হিসেবে।
সব দেখেশুনে পরিদর্শক দল পুরসভার ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটির কাছে রিপোর্ট পেশ করে। কারণ, শহরের ঐতিহ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট কমিটিরই রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, মন্দির ও দোকানের ঠিকানা অদলবদলের ভুল সংশোধন করতে হবে। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, গত মার্চে পুর হেরিটেজ কমিটির সদস্যেরাও পরিদর্শনে গিয়ে ভুলটি দেখতে পান। তার পরেই কমিটি প্রস্তাব দেয়, পুর হেরিটেজ তালিকায় গোবিন্দ দে-র মন্দিরের ঠিকানা ৭৪-এর পরিবর্তে ৭২ নম্বর ডাক্তার নারায়ণ রায় সরণি করার।
কিন্তু বিভ্রান্তির অবসান হলেও পুরো ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঠেছে পুরসভার অভ্যন্তরেই। ফের প্রকাশ্যে চলে এসেছে পুর দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের প্রসঙ্গ। কী ভাবে মূল্যায়ন দফতরের নথিতে ঠিক ঠিকানা থাকলেও পুর হেরিটেজ তালিকায় এত দীর্ঘ বছর ধরে ভুল থাকল? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, পুরসভার তরফে নীল ফলক লাগানোর পরেও কেন কারও নজরে পড়ল না ঠিকানার এই অসঙ্গতির কথা? আধিকারিকদের একাংশের বক্তব্য, নীল ফলক না লাগানো হলে তবু বলা যেত যে, বিষয়টি ওই চিঠির মাধ্যমেই প্রথমে সবার নজরে এসেছে। কিন্তু তা হয়নি এ ক্ষেত্রে। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘পুরসভা নীল ফলক লাগাল ঠিক ঠিকানায়। অথচ নথিতে যে ভুল রয়েছে, সে সম্পর্কে কেউ জানলেনই না। বিষয়টা অদ্ভুত।’’
শহরের ঐতিহ্য বিশারদদের একাংশ অবশ্য মোটেই অবাক হচ্ছেন না। এক ঐতিহ্য বিশারদের কথায়, ‘‘প্রশ্নটা ৭২ বা ৭৪ নম্বরের নয়। প্রশ্নটা হল, দফতরের সমন্বয়, শহরের ঐতিহ্য নিয়ে সচেতন হওয়ার। এই ঘটনা আসলে বুঝিয়ে দিচ্ছে পুরসভার ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এমন আরও কত ফাঁক-ফোঁকর রয়েছে। যা অতীতে জানা গিয়েছে, হয়তো আগামী দিনেও জানা যাবে।’’