বারে বারেই বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, যন্ত্রমেধার প্রচলনের ফলে যত চাকরি খোয়া যাবে, তার সিংহভাগই মেয়েদের। ২০২৩ সালে, জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর আদিপর্বে, গোল্ডম্যান স্যাকস একটি গবেষণা করে দেখেছিল যে, প্রায় ৮০% মহিলার চাকরি যন্ত্রমেধার প্রচলনের কারণে বিপন্ন হতে পারে— সেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে অনুপাতটি ৫০ শতাংশের আশেপাশে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের গবেষণাপত্রেও উঠে এল একই আশঙ্কা— যন্ত্রমেধার হাতে চাকরি হারানোর ঝুঁকি মেয়েদের ক্ষেত্রেই বেশি। না, যন্ত্রমেধার কোনও বিশেষ নারীবিদ্বেষ নেই। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, কর্মী-নিয়োগের প্রক্রিয়ায় যখন যন্ত্রমেধা ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন তার ট্রেনিংয়ের মধ্যে ঢুকে পড়া পক্ষপাত সেই প্রক্রিয়াকে মেয়েদের পক্ষে কিঞ্চিৎ প্রতিকূল করে তুলছে। কিন্তু, মূল সমস্যা সেটা নয়। প্রায় দু’বছরের ব্যবধানে— এবং, যন্ত্রমেধার মতো অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দু’বছর নেহাত কম ব্যবধান নয়— দু’টি সমীক্ষার ফলাফলই কার্যত এক কথা বলছে: শিল্পক্ষেত্রে বিগত তিনটি বিপ্লবের সঙ্গে যন্ত্রমেধা-কেন্দ্রিক চতুর্থ বিপ্লবের চরিত্রগত ফারাকই এই বৈষম্যের কারণ। পূর্ববর্তী প্রতিটি পর্যায়েই যান্ত্রিক উদ্ভাবনে কাজ হারিয়েছিলেন ব্লু-কলার ওয়ার্কার বা শ্রমজীবী মানুষ। কৃত্রিম মেধা চাকরি কাড়ছে হোয়াইট কলার ওয়ার্কারদের। তাও সকলের নয়— হোয়াইট কলার চাকরির মধ্যে যেগুলির কাজের চরিত্র মূলত যান্ত্রিক, যেখানে মানুষের বিশিষ্ট মেধার প্রয়োগের অবকাশ কম, যন্ত্রমেধার কবলে চলে যাচ্ছে সে কাজগুলিই। গোটা দুনিয়াতেই— বিশেষত উন্নত দুনিয়ায়— সে কাজগুলিতে মেয়েদের উপস্থিতি ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে, মেয়েদের চাকরিই বেশি বিপন্ন।
এই কথাটিতে একটি আপাত-ব্যাখ্যা মেলে বটে, কিন্তু এক বিশেষ গোত্রের কাজেই মেয়েদের উপস্থিতি এত ঘন কেন, সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা সমাপতন নয়। অন্তত, ক্লডিয়া গোল্ডিনের নোবেল-জয়ের পরে এই প্রশ্নটির গভীরতর উত্তরের হদিস না রাখা অন্যায় হবে। ২০২৩ সালে অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী গোল্ডিন দেখিয়েছিলেন, মেয়েদের কাজের বাজার প্রভাবিত হয় এমন কিছু বিষয় দ্বারা, মূলধারার অর্থশাস্ত্র যেগুলিকে কখনও কাজের বাজারে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব হিসাবে বিবেচনাই করেনি। যেমন, মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগের মাত্রা বহুলাংশে নির্ধারিত হয় তাদের মায়েদের প্রজন্মের অর্থনৈতিক প্রত্যাশার দ্বারা। মায়েদের প্রজন্ম যদি অভিজ্ঞতালব্ধ কারণে বিশ্বাস করে যে, বিয়ের পর মেয়েরা আর চাকরি করবে না, তা হলে স্বভাবতই পরিবারের পরিসরে মেয়েদের শিক্ষাখাতে কম বিনিয়োগ করা হবে। প্রাক্-যৌবনে উচ্চশিক্ষার সুযোগ না পেলে কোনও মেয়ে তার গোটা কর্মজীবনেই পিছিয়ে থাকে। আবার, সন্তানধারণ ও তার প্রতিপালনের দায়িত্ব মেয়েদের ঘাড়েই বর্তাবে, ফলে পেশাদার জীবনের এক মোক্ষম সময়ে চাকরি তাদের অখণ্ড মনোযোগ পাবে না, এই আশঙ্কায় নিয়োগকর্তারা মেয়েদের গুরুদায়িত্ব থেকে দূরে রাখতে চান। এমন বিবিধ কারণে মেয়েদের চাকরি সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে নিচু স্তরের হোয়াইট কলার কাজে— ঐতিহাসিক ভাবেই গায়েগতরে খাটুনির কাজে মেয়েরা ব্রাত্য, আর উচ্চদক্ষতার কাজ থেকে তাদের ব্যবস্থাগত ভাবে দূরে রাখা হয়। তারা এমন কাজ করতে বাধ্য হয়, আজ যন্ত্রমেধা যে কাজ বিনা সমস্যায় রপ্ত করে ফেলতে পারছে।
এই সুগভীর ও কাঠামোগত সমস্যা থেকে মেয়েরা কী ভাবে নিস্তার পেতে পারে, সেই বড় প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে একটা অন্য কথা খেয়াল করা ভাল— এই উদাহরণটি দেখিয়ে দেয় যে, কী ভাবে অতীতের অনপনেয় ছাপ থেকে যায় সুদূর ভবিষ্যতের গায়ে। বিশ শতকের প্রথম পর্বে যে মহিলারা বেছে নিয়েছিলেন সওদাগরি অফিসে টাইপিস্টের কাজ, এবং পরবর্তী কালে নিজেদের অভিজ্ঞতার নিরিখে স্থির করেছিলেন যে, কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রেও টেলিফোন অপারেটরের চাকরির জন্য প্রস্তুত হওয়াই ভাল, যন্ত্রমেধা তাঁদের সুদূরতম কল্পনার দিগন্তরেখাতেও ছিল না। অথচ, তাঁদের সেই সিদ্ধান্ত আজকের মেয়েদের পেশাদারি জগতের সীমারেখা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ঠিক এই কারণেই বর্তমানের, এমনকি ভবিষ্যতের, সমস্যার সমাধানসূত্র খোঁজার জন্য অতীতের দিকে তাকানো প্রয়োজন। কোনও পক্ষপাত ছাড়াই, অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে। হয়তো সন্ধান মিলবে এমন কোনও কারণের, যা দূর না করতে পারলে ভবিষ্যতের সমস্যার সমাধান হবে না কখনও।