মধ্য এপ্রিলের ঘটনাবলির পরে ভয়ানক এক প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে নবাব-ভূমি। সেই সঙ্গে গোটা রাজ্যও। সম্প্রীতি, সহাবস্থানের সুদীর্ঘ পরম্পরা ভুলে ধর্মীয় বিভাজনই কি এর পরে একমাত্র ভবিতব্য?
ভবিষ্যতের প্রশ্ন মাথায় রেখেই মুর্শিদাবাদে অশান্তির নেপথ্য কাহিনি অনুসন্ধানের কিছু চেষ্টা করেছিল আনন্দবাজার। কেন্দ্রীয় সরকারের সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদকে উপলক্ষ করে উস্কানি এবং গুজব মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জ, ধুলিয়ান, সুতিতে গোলমালকে এই চেহারায় পৌঁছে দিয়েছে, এমন কারণই উঠে আসছে প্রশাসনের প্রাথমিক তদন্তে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশের বক্তব্যও তা-ই। কিছু কাঁচা টাকার প্রলোভনে এবং মিছিল থেকে মদের দোকান লুট করে উন্মত্ত বাহিনীর তাণ্ডব, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা—সবই উঠে আসছে সরেজমিন অনুসন্ধানে।
এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট, ধুলিয়ানের বেতবোনা, সরকারপাড়া বা দাসপাড়ার ঘটনার সঙ্গে জাফরাবাদের ঘটনার বড় রকমের ফারাক আছে। বেতবোনায় যেমন পাড়া ধরে ১৩৯টি বাড়িতে লুটপাট, আগুন লাগিয়ে তাণ্ডব চালানো হয়েছে। কিন্তু জাফরাবাদে বাড়ি বাড়ি ঢুকে এমন লুটপাট হয়নি। বাবা-ছেলের বাড়ির দরজা ভাঙা হয়েছে, বাইরের রাস্তায় দু’জনকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। বিশেষত, ছেলের উপরে নৃশংসতা স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো। পাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগের তির পাশের পাড়ার দিকে। খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে পুলিশ যাদের এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করেছে, তাদের ঠিকানা নিহতদের বাড়ি থেকে কয়েকশো মিটার দূরে। ওয়াকফ-প্রতিবাদের সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত না থেকেই জাফরাবাদের দুই বাসিন্দা এত আক্রোশের শিকার কেন?
প্রশাসন, আইনজীবী এবং স্থানীয় নানা সূত্রের ইঙ্গিত, এই আক্রোশের বীজ পুরনো বিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। ওই সূত্রের বক্তব্য, জাফরাবাদের ওই বাড়িতে ভিন্ ধর্মে বিয়ে নিয়ে দু’তরফের মধ্যে আগে সমস্যা হয়েছিল, চাপা উত্তেজনাও ছিল। ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ ঘিরে অশান্তির মধ্যেই সুযোগ পেয়ে পুরনো রাগ মেটানোর চেষ্টা হয়ে থাকতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর সফরের আগের দিন জাফরাবাদের ওই পরিবার এলাকা ছেড়েছে, এখনও ফেরেনি। জোড়া খুনের নেপথ্যে অন্য কিছু আছে কি না, সেই প্রশ্নে পুলিশ সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, এখনও সবটাই তদন্তাধীন।
বাবা এবং দাদাকে হারানোর পরে জাফরাবাদের ওই বাড়ির ছোট ছেলে এখন সপরিবার কলকাতার কাছে নিভৃতবাসে। তিনি বলছেন, “ঘটনার দিন আমি সেখানে ছিলাম না। খবর পেয়ে তামিলনাড়ু থেকে ফিরেছি। শুনেছি, আশপাশের লোকেরাই হামলা করেছিল। আমরা তো কারও ক্ষতি করিনি। কেন এই রকম ঘটে গেল, বুঝতে পারছি না।” তদন্তের জন্য তাঁদের কোনও বয়ান নেওয়া হয়নি জানিয়ে তাঁর দাবি, “পুলিশের উপরে আমাদের আস্থা নেই। এলাকায় বিএসএফের স্থায়ী ছাউনি চাই।” কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত চেয়ে হাই কোর্টে ওই পরিবারের আবেদন আপাতত বিবেচনাধীন।
জাফরাবাদের জোড়া খুন, বেতবোনার লুটপাটকে হাতিয়ার করেই মেরুকরণের রাজনীতিতে শাণ দেওয়ার সব রকম আয়োজন চলছে। অকুস্থলে ঘুরে অবশ্য টের পাওয়া যাচ্ছে, আক্রান্ত মানুষ বিভ্রান্ত। ক্ষুব্ধও। বছরের পর বছর পাশাপাশি বাস করে আসা মানুষ কোনও প্ররোচনায় বা উস্কানিতে কী ভাবে কয়েক ঘণ্টার জন্য এমন দানবীয় আচরণে মেতে উঠল, তার কোনও ব্যাখ্যা পাচ্ছেন না কেউই। তবে ওই ঘটনার জেরে নিজেদের এলাকায় পাকাপাকি দেওয়াল তোলেননি তাঁরা। পাড়ায় পাড়ায় যাতায়াত চলছে, দুই সম্প্রদায়ের মানুষ পরস্পরের মুখ দেখা বন্ধ করেননি। একই উদ্বেগে তাঁরা পরিস্থিতি মাপছেন। বিনয় মণ্ডল বা মর্জিনা বেওয়া একই সুরে বলছেন, “আমরা তো কেউ কারও শত্রু নই।”
তাণ্ডবে ঘর ভেঙেছে ঠিকই। তবে মনের মধ্যে দেওয়াল ওঠেনি।
(শেষ)