অন্য দিকে, উধমপুরে পাকিস্তানি ড্রোনের অংশের আঘাতে নিহত হয়েছেন এক সেনা।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ মুনির কি সংঘর্ষবিরতি অস্বীকার করলেন? নাকি পাক সেনার সঙ্গে মিশে থাকা লস্কর-ই-তইবার জঙ্গিরা এখনও লড়াই চালিয়ে যেতে চাইছে? রাত পৌনে ১১টায় সাংবাদিক বৈঠক করে বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী বলেন, ‘‘আজ সন্ধ্যায় দু’দেশের সেনার ডিজিএমও-র মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল। শেষ কয়েক ঘণ্টায় বেশ কয়েক বার সমঝোতা ভঙ্গ করেছে পাকিস্তান। ভারতীয় সেনা এর জবাব দিচ্ছে। সীমান্ত পেরিয়ে হানারও মোকাবিলা করছে। আমরা এই সমঝোতা লঙ্ঘনকে অত্যন্ত, অত্যন্ত গুরুতর বিষয় হিসেবে দেখছি। আমরা পাকিস্তানকে বলেছি, এই সমঝোতা লঙ্ঘন নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ও দায়িত্বশীল ভাবে যথাযথ পদক্ষেপ করতে। সশস্ত্র বাহিনী পুরো বিষয়টির উপরে কড়া নজর রাখছে। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণরেখায় এমন সমঝোতা ভঙ্গের আরও কোনও ঘটনা দেখলে তারা কড়া হাতে তার মোকাবিলা করবে।’’ অন্য দিকে, পাক বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, ‘‘ভারত কয়েকটি এলাকায় সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করলেও আমাদের বাহিনী দায়িত্বজ্ঞান ও সংযমের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে। পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতি সুষ্ঠু ভাবে কার্যকর করার পক্ষপাতী।’’
এর মধ্যে আজ রাতে জম্মুর নাগরোটার সেনা ছাউনির বাইরে এক সন্দেহভাজন ব্যক্তির সঙ্গে গুলি বিনিময়ে আহত হয়েছেন ছাউনির রক্ষী জওয়ান। সূত্রের বক্তব্য, এর আগে ভারত, পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি কার্যকর করতে বিশ্বের অনেক মহলই সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল। আড়ালে চলছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের দৌত্য এবং চাপ বাড়ানোর কূটনীতি। গতকাল গোটা রাত এবং আজ বেলা পর্যন্ত যুদ্ধকালীন চূড়ান্ত তৎপরতা এবং সীমান্তের দিকে সেনাবাহিনীর অগ্রসর হওয়ার খবরের মধ্যেই আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কার্যত বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তাঁর এক্স হ্যান্ডলে। ভারত এবং পাকিস্তান তো বটেই, গোটা উপমহাদেশই দেখল, ট্রাম্প লিখছেন: ‘‘আমেরিকার মধ্যস্থতায় রাতভর (আমেরিকার হিসেবে) আলোচনার পরে, আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি, যে ভারত এবং পাকিস্তান অবিলম্বে পূর্ণ সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’’ এর পরেই ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে স্বাগত জানিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য, ‘‘বাস্তবজ্ঞান এবং অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সদ্ব্যবহার করার জন্য দুই দেশকে অভিনন্দন। এই বিষয়ে (সংঘর্ষবিরতি) মনোযোগ দেওয়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ!’’
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ছ’টার সময় বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের আধ ঘণ্টা আগেই অতলান্তিকের ও-পারে বসে সংঘর্ষবিরতির কৃতিত্বটুকু কার্যত নিয়ে গেলেন ট্রাম্প। একই সঙ্গে গোটা মধ্যস্থতার কূটনীতিতে হোয়াইট হাউসের সিলমোহর মেরে দিলেন— এমনটাই মনে করছে সংশ্লিষ্ট শিবির। সন্ধ্যাবেলা সাংবাদিক সম্মেলনে সংঘর্ষবিরতি ঘোষণার আগেই বিশ্ব জেনে গেল, এ ক্ষেত্রে কূটনীতির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে। তবে রাতে সীমান্ত ফের উত্তপ্ত হওয়ায় পরিস্থিতি আবার আগের জায়গায় ফিরে যায় কি না, তা নিয়ে স্নায়ুচাপ বেড়েছে আমেরিকা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তাদের।
অথচ, আজ বিকেলে দু’দেশের ডিজিএমও পর্যায়ের আলোচনাতেই স্থির হয়ে যায়, চলতি সংঘাতের ভবিষ্যৎ। পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার বরং কিছুটা সামনের পায়ে এসে আগাম আভাস দিয়েছিলেন সংঘর্ষবিরতির। আজ দুপুরে তাঁর বক্তব্য, ভারত ‘হামলা’ থামালে, থামবে পাকিস্তানও। দার দাবি করেন, ভারত যদি আবার ‘হামলা’ চালায়, তা হলে তার জবাব দেবে পাকিস্তান। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমকে দার জানান, এই বিষয়টি আমেরিকার বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়োকেও জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের ধৈর্যের সীমা শেষ হয়েছে। সে কারণেই জবাব দিয়েছি। ওরা থামলে আমরাও থামার বিষয়ে বিবেচনা করব।’’ সন্ধ্যায় সংক্ষিপ্ত সাংবাদিক সম্মেলন করে বিদেশসচিব মিস্রী জানান, শনিবার দুপুর ৩টে ৩৫ মিনিটে ভারতীয় সেনার ডিজিএমও-কে ফোন করেন পাকিস্তানের ডিজিএমও। তার পর দু’পক্ষই গোলাগুলি এবং সামরিক অভিযান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর বক্তব্য, “পাকিস্তানের ডিজিএমও ভারতের ডিজিএমও-কে ফোন করেন আজ বিকেল ৩টে ৩৫-এ। দু’পক্ষ জল, স্থল এবং আকাশপথে সমস্ত ধরনের গোলাগুলি এবং সামরিক অভিযান বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে। বিকেল ৫টা থেকে এটি কার্যকর হয়।”
কূটনৈতিক শিবিরের মতে, আমেরিকা এই নাট্যের প্রধান গুরু ঠিকই, কিন্তু পিছনে একাধিক সমীকরণ কাজ করছে। এর আগে আমেরিকা যখন সামরিক প্রসঙ্গে নিজেদের কোনও স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পদক্ষেপ করতে চেয়েছে, দেখা গিয়েছে ওয়াশিংটন সরাসরি রাওয়ালপিন্ডির সঙ্গে কথা বলেছে ইসলামাবাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবজ্ঞা করেই। কারণ, আমেরিকা ভাল ভাবেই জানে যে, পাক সেনা এবং আইএসআই সে দেশে শেষ কথা বলে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার বিদেশসচিব (যিনি কি না সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও বটে) মার্কো রুবিয়ো কথা বলছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের সঙ্গে। সেই কথায় কোনও বরফ গলিছিল না বলেই সূত্রের খবর। আজ তিনি সরাসরি কথা বলেন সে দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ মুনিরের সঙ্গে, যিনি সামনে থেকে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘটনা হল, কাল রাত থেকেই একটি খবর পাকিস্তানের তরফ থেকে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে নড়ে বসে আমেরিকা— সে দেশের পরমাণু অস্ত্রের দেখভাল করা জাতীয় কমান্ড-এর বৈঠক ডেকেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী। এই খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসার পর তিলার্ধ অপেক্ষা করেননি রুবিয়ো। সরাসরি ফোন করে মুনিরকে চাপ দিয়েছেন, অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে। তবে মুনির সেই অবস্থানে কতটা বহাল থাকবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে রাতেই। অন্তত কাশ্মীরে সংঘর্ষবিরতি ভঙ্গের ঘটনায় এমনটা মনে করা হচ্ছে।
পাশাপাশি আমেরিকার মিত্র রাষ্ট্র সৌদি আরবের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী আদেল আল-জুবেরের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছাড়াই নয়াদিল্লিতে আসা এবং এস জয়শঙ্করের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করাকেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। সৌদি কথা বলেছে পাকিস্তানের সঙ্গেও। সৌদি বিদেশ দফতরের তরফে একটি এক্স পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘‘ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন আদেল। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনমনীয় ভাবে লড়াই করার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে।’’
চিনের ভূমিকাকেও তুলে ধরছে কূটনৈতিক মহল। পিছন থেকে পাকিস্তানকে মদত দেওয়া, তাদের অস্ত্রভান্ডারের একটা বড় অংশ তৈরি করে দেওয়ায় বেজিংয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে এ বারের সংঘাতে ভারত-বিরোধিতার প্রশ্নে কিছুটা উদাসীনই ছিল চিন। কারণ, বর্তমানে আমেরিকার সঙ্গে শুল্ক-যুদ্ধে যুযুধান বেজিং এমন কোনও অস্থিরতা দক্ষিণ এশিয়ায় চাইবে না যাতে, তাদের বিপুল বিনিয়োগ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী তথা বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার সন্ধ্যায় দাবি করেছেন, এই সংঘর্ষবিরতির জন্য ৩৬টি দেশ সক্রিয় আলোচনায় জড়িত ছিল! মার্কো রুবিয়ো ছাড়াও সৌদি আরব এবং তুরস্কও অস্ত্রবিরতি সংক্রান্ত আলোচনায় জড়িত ছিল, দাবি তাঁর। তিনি জানান, শনিবার সকালে ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির সঙ্গেও তাঁর কথা হয়। সংঘর্ষবিরতির জন্য ল্যামির ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। ল্যামির সঙ্গে গত রাতে কথা বলেছেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করও।