নিয়ন্ত্রণ মরীচিকা
কট্টরপন্থা থেকে যেমন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্ম হয়, তেমনই কোনও সন্ত্রাসের পর কট্টরপন্থীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দাপট বাড়ে দ্রুততর গতিতে। বিশেষজ্ঞরা একে ‘রিঅ্যাকটিভ’ চরমপন্থা বলে বর্ণনা করেন: সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় জয়ের জায়গা সেখানেই। সেই দিক দিয়ে, কাশ্মীর উপত্যকায় পহেলগাম-পরবর্তী সময়ে বিপদ বাড়ার সম্ভাবনা। যদিও এ বারের ভয়ঙ্কর হানার পর থেকে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ— অভূতপূর্ব ভাবেই— সদলবলে বেরিয়ে এসে হামলার নিন্দা করছেন, দুঃখ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন, পর্যটকদের নিশ্চিন্ত করার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়েছেন, তবু প্রকৃত পরিস্থিতি কেমন তা হয়তো এখনও অস্পষ্ট। এক দিকে যেমন পর্যটকরা মুখ ঘুরিয়ে নিলে কাশ্মীরের দীনাবস্থা উত্তরোত্তর গভীর হবে, অন্য দিকে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের পর গোটা দেশে কাশ্মীরি ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ ধাবিত হওয়ায় সে রাজ্যের মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ার সম্ভাবনা। পহেলগাম হামলার পর কাশ্মীরে গিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেনা ছাউনিতে গেলেন, সেনাদের মনোবল বাড়ানোর প্রয়াস করলেন। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সফর করে এলেন। কিন্তু কাশ্মীরি জনসাধারণের অতলান্ত হতাশা ও আশঙ্কা কতখানি দূরীভূত হল, তা গভীর সংশয়ের বিষয়।
জঙ্গি হানার পর পরিস্থিতি জটিলতর হলেও বাস্তব এটাই যে কাশ্মীরি সমাজ অনেক দিন ধরেই এই হতাশা ও আশঙ্কায় গ্রস্ত। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বারংবার বলেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরে ‘স্বাভাবিকতা’ ফিরেছে বলে উপর্যুপরি দাবি করলেও সেই স্বাভাবিকতা আসলে একেবারেই ‘উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া’, সমাজের অভ্যন্তরে আসলে চারিয়েছে গভীর অসন্তোষ, অবিশ্বাস, ব্যাপক ক্ষোভ। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর অসন্তোষ বহু দূর ছড়িয়েছিল। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচন সত্ত্বেও নির্বাচিত সরকারকে সত্যিকারের মর্যাদা না দেওয়ার কারণে, এবং অর্থনীতির রাশ ধীরে ধীরে উপত্যকাবাসীর নাগাল-বহির্ভূত হয়ে যাওয়ার কারণে তা এখন ক্রমশ ব্যাপ্ততর হওয়ার সম্ভাবনা। পহেলগাম ঘটনার পর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী এখন প্রত্যহই স্থানীয় জঙ্গি নেতাদের তল্লাশে ব্যস্ত, একাধিক জঙ্গি নিহত হয়েছে। তবে পহেলগাম ঘটনার আক্রমণকারী জঙ্গিরা কিন্তু কেউই এখনও ধরা পড়েনি। এক দিকে স্বশাসনের দাবি, স্বাভাবিক নাগরিক অধিকারের দাবি, অন্য দিকে পাকিস্তান-উদ্দীপিত জঙ্গি মৌলবাদের আকর্ষণ, সব মিলিয়ে গভীর ভাবে বিভক্ত উপত্যকার পরিস্থিতিটি উদ্বেগজনক। সংঘর্ষবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার নানা দাবি ও প্রতিদাবির আলোড়নের মধ্যে এই সঙ্কটসঙ্কুল উপত্যকায় শান্তির ইঙ্গিতমাত্র নেই। প্রত্যহ যেন আরও বড় বিপদের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে এই সীমান্তভূমি।
এ দিকে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথে যে ভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তাতে বিষয়টি অধিকতর বিষায়িত হয়ে উঠছে। ১৯৪৭ থেকে ভারত একাদিক্রমে চেষ্টা করেছে যাতে বহিঃশক্তি কাশ্মীর সঙ্কটে নাক না গলায়। বারংবার ভারতকে এ ক্ষেত্রে হার মানতেও হয়েছে। তবে এ বার অপারেশন সিঁদুর যে ভাবে সংঘর্ষবিরতিতে পৌঁছল, তাতে ‘কাশ্মীর সঙ্কট’-এর আন্তর্জাতিকীকরণের নতুন সম্ভাবনা উপস্থিত। অন্য দিকে, আমেরিকার নবোচ্চারিত ‘আগ্রহ’ ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায়, এবং চিনের ক্রমবর্ধমান পাকিস্তান-সমর্থন ইসলামাবাদের ‘পিওকে’ কার্যক্রমে নতুন উৎসাহ জোগানোয়— কাশ্মীরের কট্টরপন্থীরাও নতুন করে বলীয়ান বোধ করতে পারে, তাদের ভারতবিরোধিতায় ইন্ধন আসতে পারে। পহেলগাম-কাণ্ড ভারতের জন্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটও বাড়িয়ে তুলতে পারে। শুধু নিয়ন্ত্রণরেখা অঞ্চল নয়, সমগ্র কাশ্মীরই বিপদ-আবর্তে নিমজ্জমান।