বিরাট পর্ব
ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় চতুর্থ স্থানে থামলেন বিরাট কোহলি। এগিয়ে শুধুমাত্র সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, সুনীল গাওস্কর। এই ক্রমাঙ্কই কোহলির অবদানের নির্দেশক। ‘দশ হাজার ক্লাব’-এর সদস্য হতে পারলেন না, গত পাঁচ বছর নিষ্প্রভ থাকায় কেরিয়ার কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্গেও পৌঁছল না। কিন্তু, ১২৩ টেস্ট, ৯২৩০ রান, ৩০টি সেঞ্চুরির হিসাবতত্ত্বে বিরাট কোহলিকে পুরোটা ধরা মুশকিল। তাঁরই কথায়, সচিন আড়াই দশক দেশকে বহন করেছিলেন। আর কোহলিকে বইতে হয়েছে স্বয়ং তেন্ডুলকরের উত্তরাধিকারী হয়ে ওঠার ভার। বিশেষত ২০১৪-১৯ পর্বে কোহলি দেখিয়েছেন, পরিশ্রমের ছাঁচে প্রতিভাকে মেলে কী ভাবে ধাপে ধাপে প্রজন্ম-সেরার বিগ্রহ গড়া যায়। এবং পাল্টে দিয়েছিলেন ভারতের ক্রিকেটের চেহারাটা।
তাঁর আবির্ভাব আইপিএল-লগ্নে। ২০০৮-এই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক হিসাবে আলোয় আসা, ঠিক যে বছর ক্রিকেট হয়ে উঠল নির্ভেজাল বিনোদন— বলিউডের ধুন্ধুমার ছবিকে প্রতিযোগিতায় টেক্কা দিতে সক্ষম এক মহা-উদ্যাপন। বিরাট এই সময়েরই প্রতিভূ। তাঁর চরিত্রেও আইপিএল-রঙেরই বিচ্ছুরণ আর নাটকীয়তা দর্শনীয়। কিন্তু, যখন কিংবদন্তিরাও টেস্টের পরিশ্রমকে পাশ কাটিয়ে খ্যাতির কুড়ি ওভারের শর্টকাট বেছে নিচ্ছেন, ঠিক তখনই তিনি বলে দিয়েছিলেন কেন পাঁচ দিন খেলাই তাঁর মোক্ষ, আর কী ভাবে সেখানে খেলোয়াড়ের অগ্নিপরীক্ষা হয়। সেই অটল বিশ্বাসই অদম্য প্রাণশক্তি হয়ে তাঁর সঙ্গে জগিং করতে করতে ছুটত ক্রিজ়ে, চোখের অগ্নিগোলক থেকে বিচ্ছুরিত হত মুঠোয় হ্যান্ডল ধরে ব্যাট ঘোরানোর পরিচিত স্টান্সে, তুলির টানের মতো নিখুঁত ড্রাইভে লাল গোলক পেরিয়ে যেত বাউন্ডারি। অন্য দিকে, অধিনায়ক কোহলি স্পিন-নির্ভর দেশকে হঠাৎ পরিণত করলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ়-সম ভয়ঙ্কর পেস-ব্যাটারিতে। ‘দেশের বাঘ’ তকমা ঝেড়ে টিম ইন্ডিয়া সাগরপারেও অপরাজেয় হল। অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কঠিন পিচে কোহলির দাপট মাঝেমাঝে স্বয়ং সচিনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এমনকি, যে দিন রান পাননি, সে দিনও তাঁর শরীরী ভাষ্যেই উদ্ভ্রান্ত বিপক্ষ। ক্যাপ্টেন্সি ছাড়ার পরও শর্ট লেগ থেকে উদ্দীপ্ত করেছেন বোলারদের।
কোহলির আমলে ভারতীয় ক্রিকেটের যে পর্বান্তর হল, তা তাঁর পূর্বসূরিদের তুলনায় চরিত্রে পৃথক। গত আড়াই দশকে ভারতীয় ক্রিকেট তিন অতি তাৎপর্যপূর্ণ অধিনায়ককে দেখেছে— উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কিছু খেলোয়াড়ের সমষ্টিকে প্রথম একটি যূথবদ্ধ দল হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়; মহেন্দ্র সিংহ ধোনি সে দলে এনে দিয়েছিলেন কাউকে পরোয়া না করা তারুণ্যের স্পর্ধা। আর, বিরাট কোহলি ভারতীয় দলকে পরিণত করেছেন এক অপরাজেয় শক্তিতে। ব্যাটার হিসাবে যতখানি, অধিনায়ক হিসাবে ভারতীয় ক্রিকেটে কোহলির গুরুত্ব সম্ভবত তার চেয়েও বেশি। সত্তরের দশকের ক্লাইভ লয়েড বা নব্বইয়ের দশকের স্টিভ ওয়র সঙ্গে তাঁর তুলনা করা চলে কি না, সে প্রশ্নটি ক্রিকেট ইতিহাসবিদদের জন্য থাকুক। তবে, বিরাট কোহলি খেলা ছাড়ার মুহূর্তেও প্রমাণ রাখলেন তাঁর নিখুঁত টাইমিং ক্ষমতার— কখন ছাড়লে লোকে বলে ‘এখনই কেন’, আর কত দিন জায়গা ধরে থাকলে প্রশ্ন ওঠে ‘এখনও নয় কেন’, তা বুঝতে তিনি ভুল করেননি।