শহরের একটি নামকরা স্কুলের পোশাক পরিহিত দু’জন ছাত্রের মধ্যে কথা হচ্ছে, বাসে। বিষয় খুবই দৈনন্দিন। কথার মাঝে মাঝে, হিন্দিতে, অবিরল চলছে অকথা-কুকথার স্রোত। চার পাশে বয়স্ক মানুষজন রয়েছেন। কিন্তু, তাদের সেই খেয়ালটুকুও নেই। যেন নিজেদের এক জগতে রয়েছে তারা।
অফিস থেকে ফিরছেন এক দল মাঝবয়সি ভদ্রলোক, ট্রেনে, তাস খেলছেন। টিপ্পনী আর পরস্পর খুনসুটির সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসছে তীব্র অকথা-কুকথার ঝলক। নিত্যযাত্রীদের এই কামরায় মেয়েরাও আছেন, আছে শিশু-কিশোরেরা। বাকিদের কানে যে সে সব কথা পৌঁছচ্ছে না তেমনও নয়। কিন্তু সে দিকে তাঁদের খেয়াল নেই।
এই ভাষাটার সঙ্গে আমরা যে একেবারেই অপরিচিত তা নয়। বিভিন্ন বয়সে, আড্ডায় এই ধরনের কথাবার্তা চলে। তবে, সামাজিক পরিসরে— যাকে বলি ‘পাবলিক প্লেস’— এ ধরনের শব্দবন্ধের ব্যবহার আজ খুব সাধারণ। অথচ, আমরা আমাদের কৈশোরে খেয়াল করতে পারি, বড় দাদাদের মধ্যে তুমুল অকথা-কুকথা সমেত আড্ডা চলছে, আমরা ঢুকতেই, এ অন্যকে চোখের ইশারায় সতর্ক করে দিল, ‘ছোটরা এসেছে, সংযত হয়ে যাও!’ স্কুলের পোশাকে এক বার রিকশাচালকদের ঝগড়ার মাঝখানে পড়ে গিয়ে দেখেছি, কী আশ্চর্য ভাবে তাঁরাও সংযত হয়ে গেছেন। আজকাল ভাষার এই সহবত কী ভাবে যে হারিয়ে গেল!
ভাষা নিয়ে কমবেশি যাঁরা চিন্তা করেন তাঁরা জানেন, একটি ভাষা তার সর্বাধিক পিতৃতন্ত্র ও স্বৈরাচার অভ্যাস করে তার কুকথা বা গালাগালিতে। সাধারণ কথার মধ্যে কুকথা যুক্ত করে কী হয়? আপাতভাবে মনে হয়, এক রকম ভাবে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায়। আসলে কথার মধ্যে কুকথা ঢুকিয়ে কথার শ্লেষ বাড়ানো হয়।
কুকথা দিয়ে কথার জোর বাড়াতে হলে বুঝতে হবে, দৈনন্দিন ব্যবহার্য শব্দের ভান্ডারে শ্লেষ কম পড়ছে। কেন কম পড়ছে? একটি ভাষার শব্দভান্ডারের উপরিতলে কিছু শব্দ থাকে, সেগুলি দীর্ঘকাল ব্যবহৃত হতে হতে হয়ে ওঠে একেবারেই সাদামাঠা। ফলে শব্দগুলির জোর কমে আসে। তখন প্রয়োজন পড়ে বাড়তি শ্লেষের। সেই অতিরিক্ত শ্লেষের জোগান দেয় কুকথা।
এর বিকল্প কী? ভাষার তলদেশ থেকে শব্দ তুলে আনা, তাকে রোজকার ব্যবহারের মধ্যে নিয়ে আসা। কাজটা খুব সহজ নয়, বেশ পরিশ্রমের। এ কাজ করতে দরকার ভাষার প্রতি নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ। সেই পরিশ্রম করতে আমরা বহু ক্ষেত্রেই অপারগ বা নারাজ। এ ক্ষেত্রে কুকথা যেন খুব সহজ বিকল্প। আকাদেমির মাঠে দাঁড়িয়ে, তরুণ কবিদের আড্ডায় কান পেতে শুনেছি ভাষার এই পিতৃতান্ত্রিক অভ্যাস। অথচ তাঁদের থেকে কাম্য ছিল ভাষার গভীর থেকে নতুন শব্দ তুলে ভাষাকে সাজিয়ে দেওয়ার
পরিশ্রমী প্রচেষ্টা।
সমাজমাধ্যমে একটা পোস্ট মাঝে মাঝেই খুব সামনে আসে। দেওয়ালে লেখা— ‘কথাতেই যত্ন, কথাতেই বিচ্ছেদ’। আমরা ভাবি এই কথাটা বুঝি সম্পর্ক নিয়ে। কিন্তু, কথার যত্ন? আমাদের যে আটপৌরে কথা বলার ভাষা, তারও তো যত্নের প্রয়োজন হয়। এখন কি এ রকম হয়— কথার মধ্যে কেউ এমন একটা শব্দ বললেন, যেটা হয়তো খুব অসাধারণ নয়, কিন্তু আজকালকার ব্যবহারে অপ্রচলিত। অথবা ধরা যাক, কথায় কথায় কেউ এক জন ধরিয়ে দিলেন, এই শব্দের এই প্রয়োগটা হয় না। যেমন একটা সময় শোনা যেত, শঙ্খ ঘোষ, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন সহজ সাধারণ আড্ডায় বসেছেন, কথায় কথায় সেখান থেকে ভাষার মণিমাণিক্য উদ্ধার হচ্ছে। কখনও-কখনও সেই আড্ডা লিখিত ভাবেও বেরিয়েছে। পাঠক সমৃদ্ধ হয়েছেন— ‘সখ্যতা কথাটা হয় না, ওটা সখ্য’, অথবা ‘গদ্য লেখার সময় সাথে লেখো কেন, সঙ্গে লিখবে’, এই সব বাক্যে।
একুশে ফেব্রুয়ারির তুলনায় উনিশে মে দিনটা আমাদের চোখের সামনে দিয়ে দুয়োরানির মতোই চলে যায়। ভাষার আগ্রাসন নিয়ে কথা হয়, ভাষা-শহিদদের নিয়েও কোথাও কোথাও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেমিনার হয়। কিন্তু, আমরা যারা প্রতি দিন এই ভাষায় চিন্তা করি, কথা বলি, অর্থ বা যশ উপার্জন করি, ভাষাটাকে যত্ন করার কিছু দায়িত্ব তাদেরও থেকে যায় না কি?
হিন্দি শব্দ ও তার ব্যবহারিক প্রভাব কী ভাবে গিলে খাচ্ছে বাংলা ভাষার মাধুর্য, বাংলা ভাষায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দেওয়া যাবে কি না— শুধু এটুকু ভাবলেই একটা ভাষার প্রতি যত্ন পর্যাপ্ত হয় না। আমাদের প্রতি দিনের ব্যবহারের ভাষা কী করে আরও একটু লাবণ্যময় হতে পারে, তার শব্দভান্ডার তোলপাড় করে যদি কিছু নতুন শব্দের যথাযথ প্রয়োগ তুলে আনা যায়— সেই কাজটাও করা দরকার। আমরা ভাষা নিয়ে কথা বলি, পিতৃতন্ত্র নিয়েও, তবে আলাদা ভাবে। কিন্তু ভাষার ভিতর দিয়ে কুকথাকে সম্বল করে, চার পাশে নিয়মিত যে পিতৃতন্ত্রের স্বৈরাচারের দাপট চলছে, তাকে প্রতিরোধের কথা— চিন্তা বা অভ্যাসে রাখছি কি?