রাজ্য সরকারি কর্মচারী ছাড়াও শিক্ষক, অধ্যাপক, সরকারি সংস্থার কর্মী, পেনশনভোগীদেরও বকেয়ার হিসাব রয়েছে। এত বকেয়া মেটাতে হলে রাজ্য সরকারের কোমর ভেঙে যাবে। সেই হিসাব অনুযায়ী, আজকের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে এই বোঝার ২৫%, অর্থাৎ প্রায় ১০,৪৪২ কোটি টাকা রাজ্য সরকারকে মেটাতে হবে।
২০২২-এর ২০ মে কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যকে কেন্দ্রের হারে ডিএ এবং সেই বাবদ বকেয়া মেটানোর নির্দেশ দিয়েছিল। ডিএ-কে ‘আইনি অধিকার’ হিসেবেও উল্লেখ করেছিল। তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে রাজ্য। ২০২২-এর নভেম্বর থেকে এর আগে পর্যন্ত ১৭ বার এই মামলা শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত হলেও নিষ্পত্তি হয়নি।
আজ শীর্ষ আদালতের রায়ে পুরো বকেয়া বা কেন্দ্রের হারে ডিএ-র দাবি এখনই না মিটলেও রাজ্যের কর্মচারীরা খুশি। কর্মচারী সংগঠনগুলি মনে করছে, ডিএ কর্মচারীদের ‘আইনি অধিকার’ বলে তাঁদের দাবিতেই কার্যত সিলমোহর দিয়ে রাখল সুপ্রিম কোর্ট। অন্য দিকে, রাজ্য সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, আদালতের রায় হাতে পাওয়ার পরে তা খতিয়ে দেখে তাঁরা যা বলার বলবেন।
আজ সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকার ডিএ বাবদ বকেয়া মেটানোর প্রবল বিরোধিতা করেছিল। বিচারপতি সঞ্জয় কারোল ও বিচারপতি সন্দীপ মেহতার বেঞ্চে এই মামলার শুনানি ছিল। শুনানি শুরু হতেই বিচারপতি কারোল রাজ্য সরকারকে বলেন, “কর্মীদের স্বার্থে আপাতত বকেয়ার ৫০% মিটিয়ে দিন। আগের দিনও একই কথা বলেছিলাম। মামলার নিষ্পত্তি হলে তার পরে দেখা যাবে।” রাজ্য সরকারের আইনজীবী হুজ়েফা আহমদি বলেন, তাঁরা রাজ্যের বক্তব্য জানিয়ে একটি নোট তৈরি করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট তা খতিয়ে দেখুন। কিন্তু বিচারপতি কারোল বলেন, তাঁরা এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। আপাতত কর্মীদের স্বার্থে বকেয়ার ৫০% মিটিয়ে দিন। তার পরে বিস্তারিত শুনানি হবে। রাজ্যের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলেন, পুরো বকেয়া দিতে হলে রাজ্যকে ৪১,৭৭০ কোটি টাকা মেটাতে হবে। এর অর্ধেক বা ৫০ শতাংশও অনেক অর্থ। এতে রাজ্যের কোমর ভেঙে যাবে। কী ভাবে রাজ্য সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা মেটাবে? এ অসম্ভব বলেও দাবি করেন মনু সিঙ্ঘভি।
রাজ্যের বিপুল আর্থিক চাপের কথা শুনে বিচারপতি সঞ্জয় কারোল বলেন, সে ক্ষেত্রে তাঁরা ৫০ শতাংশের বদলে বকেয়ার ২৫% মিটিয়ে দিতে বলছেন। তাঁরা এ বিষয়ে রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল বা স্যাট-এর রায়, কলকাতা হাই কোর্টের রায় খুঁটিয়ে দেখেছেন। তার পরেই তাঁরা এই অবস্থান নিচ্ছেন। বিচারপতি সন্দীপ মেহতা বলেন, “যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের সঙ্গে এই আচরণ করা যায় না।” রাজ্যের আইনজীবী হুজ়েফা আহমদি বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের হারে ডিএ দেওয়া না হলেও এমন নয় যে রাজ্য ডিএ দিচ্ছে না। বেতন কমিশনের আগের হিসাব ধরলে ১২৫ শতাংশের বেশি হারে ডিএ দেওয়া হচ্ছে।” এক বার এই বকেয়া মিটিয়ে দিলে তার পরে সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় যা-ই দিক না কেন, তা আর পুনরুদ্ধার করা যাবে না। তার পরেও বিচারপতি সঞ্জয় কারোল ২৫% বকেয়া মেটানোর বিষয়ে অনড় থেকে বলেন, কর্মীরা রাজ্য সরকারেরই। তাদের টাকা মেটাতে সমস্যা হওয়া উচিত নয়। মনু সিঙ্ঘভি বলেন, রাজ্যের অবস্থান জানানোর জন্য সোমবার পর্যন্ত সময় দেওয়া হোক। বিচারপতিরা সেই আর্জিতে কান দেননি। রাজ্য এই বকেয়া মেটানোর জন্য তিন মাস সময় পাবে। তবে বকেয়া মেটানোর প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে চার সপ্তাহের মধ্যে শীর্ষ আদালতকে জানাতে হবে। তার পরে অগস্টে চূড়ান্ত শুনানি হবে।
মূল মামলাকারী সংগঠন কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ়ের সভাপতি শ্যামল কুমার মিত্র এবং সাধারণ সম্পাদক মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “ডিএ কর্মচারীদের যে সাংবিধানিক অধিকার, তা প্রতিষ্ঠিত হল।” কনফেডারেশনের আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার বা অল ইন্ডিয়া কনজ়িউমার প্রাইস ইনডেক্স-এর নিরিখে ডিএ দেয়। রাজ্য তা দেয় না। প্রথমে রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়ার কথা বলেছিল। তার পরে কলকাতা হাই কোর্ট সেই রায় দেয়। হাই কোর্টের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট কোনও দিনই স্থগিতাদেশ দেয়নি। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের আইনজীবী বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আজকের রায়ে আমরা এক ধাপ এগোলাম। এ বার কর্মীদের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই হবে।” মঞ্চের আর এক আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্ত বলেন, “আজ সুপ্রিম কোর্ট কার্যত হাই কোর্টের রায়ে সিলমোহর দিয়েই দিয়েছে।”
কর্মী সংগঠনের অভিযোগ, ২০১০ সাল পর্যন্ত রাজ্য বছরে দু’বার ডিএ দিত। তার পরে এক বার করে ডিএ দেওয়া হত। ধীরে ধীরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন কর্মীদের আন্দোলনের চাপে ফের ডিএ দিতে শুরু করেছে রাজ্য সরকার। যদিও রাজ্যের কর্মীরা এখন ১৮% হারে ডিএ পাচ্ছেন। কেন্দ্রের কর্মীদের ডিএ-র হার ৫৫%। ফলে সেখানেও ৩৭ শতাংশ বিন্দু ফারাক রয়েছে। ২০১৫-র পরের কেন্দ্র-রাজ্য ডিএ-র ফারাক বাবদ কত বকেয়া, সেই প্রশ্ন রয়েছে। রাজ্য সরকার ২০০৯-এর রোপা (রিভিশন অব পে অ্যান্ড অ্যালাউন্সেস)-এর অধীন পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনে ডিএ দেয়নি। রাজ্য সরকার আর্থিক বোঝার কথা বললেও তার সপক্ষে কোনও যুক্তি দিতে পারেনি। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের আহ্বায়ক ভাস্কর ঘোষ বলেন, “আর্থিক বোঝার যুক্তি মিথ্যে। রাজ্য সরকার বিভিন্ন শ্রী-প্রকল্পে বিপুল টাকা খরচ করছে।”
সরকারি কর্মচারী পরিষদের সভাপতি দেবাশিস শীলের মতে, বকেয়ার বাকি ৭৫ শতাংশও কর্মীরা পাবেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই। তৃণমূল কর্মচারী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং অল বেঙ্গল পেনশনার্স ওয়েলফেয়ার সংগঠনের রাজ্য সভাপতি মনোজ চক্রবর্তী বলেন, “এক মাসের মধ্যে ২৫% বকেয়ার নির্দেশে সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী-সহ পেনশনভোগীরা উপকৃত এবং খুশি। এ নিয়ে যাবতীয় জটিলতা দূর করতে ডিএ-র স্থায়ী আদেশনামা চালুর দাবিও জানাচ্ছি।”