রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল (স্যাট), কলকাতা হাই কোর্টের একাধিক রায় আগেই গিয়েছিল সরকারের বিপক্ষে। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টও প্রাথমিক ভাবে বকেয়া ডিএ-র ২৫% মিটিয়ে দিতে বলায় রাজ্যের যত্র আয়-তত্র ব্যয়ের সংসারে বিপুল আর্থিক বোঝা চাপার পরিস্থিতি তৈরি হল বলেই সরকারি সূত্রের দাবি। বিশেষজ্ঞ মহলের বক্তব্য, পঞ্চম বেতন কমিশনের সময়ে যাঁরা কর্মরত ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেই সেই বকেয়া পাওয়ার অধিকারী। এতে রাজ্যের কমবেশি সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু টানাটানির কোষাগারে ভোটের আগে অনুদান-প্রকল্পে টাকার জোগান এবং আদালতের রায় মেনে কর্মচারীদের দাবির একাংশ পূরণের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে গেলে ধার নেওয়া এবং অন্য খাতের খরচ ছেঁটে অর্থ জোগাড় করা ছাড়া রাস্তা তেমন খোলা নেই নবান্নের সামনে।
শুক্রবার রাত পর্যন্ত সরকারি ভাবে সরকারের শীর্ষমহলের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি এ ব্যাপারে। যদিও প্রশাসনের অন্দরের একটি অংশের অনুমান, রায়ের প্রতিলিপি হাতে পেয়ে পর্যালোচনা করবেন শীর্ষকর্তারা। এ ব্যাপারে আইনি পরামর্শও নেওয়া হতে পারে।
সর্বোচ্চ আদালতে রাজ্যই জানিয়েছিল, বকেয়া দিতে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, সরাসরি সরকারি কর্মচারীরা ছাড়াও এর আওতায় রয়েছেন সরকার পোষিত, অধিগৃহীত, স্বশাসিত, নিগম, পঞ্চায়েত-পুরসভার কর্মী, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা। যে হেতু এই মামলাটি হয়েছিল পঞ্চম বেতন কমিশনের সময়ে, তাই সেই সময়ের এই সকল কর্মীরই বকেয়া ডিএ পাওয়ার কথা। সরকারি ভাবে এ নিয়ে সরাসরি মুখ খোলা না হলেও, প্রশাসনের অন্দরের এবং কর্মচারী সংগঠনগুলির বক্তব্য, এই সব শাখা মিলিয়ে রাজ্যে কর্মীর সংখ্যা কমবেশি ৮ লক্ষ। কোর্টের রায় মানতে হলে কমবেশি বাড়তি সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ধরে রাখতে হবে ওই খাতে। রাজ্য সাধারণত বছরে এক বার ডিএ দেওয়ার রীতি চালু করেছে। সরকারের অন্দরের যুক্তি, কেন্দ্রের আর্থিক বঞ্চনার পরেও সব ধরনের ব্যয় করেও বেতন-পেনশন খাতেও বিপুল খরচ জোগাতে হচ্ছে। কেন্দ্রের কর্মচারীরা এখন ৫৫% ডিএ পাচ্ছেন। গত ১ এপ্রিল থেকে এ রাজ্যে ৪% ডিএ কার্যকর হওয়ায় রাজ্যের কর্মীরা পাচ্ছেন ১৮% ডিএ। ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের ব্যবধান থেকে গিয়েছে ৩৭% বিন্দুতে। কেন্দ্র নতুন বেতন কমিশনের প্রস্তুতি শুরু করলেও, রাজ্য এ ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে, দাবি কর্মচারী সংগঠনগুলির।
লোকসভা ভোটের আগে লক্ষ্মীর ভান্ডারে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এই প্রকল্পে উপভোক্তার সংখ্যাও বেড়েছে। ফলে ২০২৪-২৫-এ লক্ষ্মীর ভান্ডারের খাতে ১৪,৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও, চলতি বছর (২০২৫-২৬) তা বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ভোটের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আবাস যোজনা খাতে ১২ লক্ষ উপভোক্তার জন্য রাজ্য বরাদ্দ করেছে প্রায় ১৫,৪৫৭ কোটি টাকা। আগামী ভোটের আগে আরও ১৬ লক্ষ উপভোক্তাকে বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আরও অন্তত ১৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে।
আর্থিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের দাবি, নড়বড়ে কোষাগার নিয়ে ভোটমুখী প্রকল্পগুলির বিপুল খরচ সামলাতে এই প্রথম অন্য খাতের বরাদ্দ কাটছাঁট করেছে নবান্ন। গত বছরের তুলনায় স্বাস্থ্যসাথী প্রায় ৯০৭ কোটি, কন্যাশ্রী খাতে প্রায় ৫৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ কমেছে। রূপশ্রী, শিক্ষাশ্রী, সবুজ সাথী, কৃষকবন্ধু (নতুন) প্রকল্পেও বরাদ্দ কমেছে। সম্প্রতি শিল্পে উৎসাহ-ছাড় প্রত্যাহারের নেপথ্যে এই সামাজিক-অনুদান প্রকল্পগুলি চালিয়ে যাওয়া যে অন্যতম কারণ, তা-ও স্বীকার করেছে নবান্ন।
রাজ্যের অর্থ-কর্তাদের একাংশ স্বীকার করছেন, ২০২৩-২৪ সালের তুলনায় ২০২৪-২৫ সালের সংশোধিত হিসাবে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ১৭,৫৭০ কোটি টাকা বেড়েছে। প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে রাজকোষ ঘাটতি। পুঞ্জীভূত ধারের পরিমাণও বেড়েছে প্রায় ৭২,৫৭১ কোটি টাকা। সরকারের অনুমান, চলতি বছর ওই ধারের মোট পরিমাণ পৌঁছতে পারে ৭ লক্ষ ৭১ হাজার ৬৭০ কোটি টাকায়। তাই ধার শোধের পরিমাণও এ বছর বাড়তে পারে। পর্যবেক্ষক মহলের বক্তব্য, এই অবস্থায় ডিএ বাবদ খরচ মেটাতে হলে ধার করা এবং অন্য খরচে রাশ টানা ছাড়া উপায় নেই। কারণ, ভোটমুখী অনুদান-প্রকল্পগুলির উপর আঁচ আসুক, তা চায় না নবান্ন।