শনিবারের চিঠির এই ক্রমাবনতির যুগে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা— ভাদ্র সংখ্যায় ‘নরকের কীট’ প্রকাশ (ভাদ্র, ১৩৬৬)... এই একটি গল্পের আঘাতে বাংলা সাহিত্য-সরোবর তোলপাড় হইয়াছিল। শ্রীবনবিহারী মুখোপাধ্যায় যদি আর কোন গল্প না লিখিতেন— শুধু একটির জোরে অমর হইয়া থাকিতেন।”
সজনীকান্ত দাশ ‘আত্মস্মৃতি’তে এমন প্রশস্তি করেছেন বনবিহারী মুখোপাধ্যায় (১৮৮৫-১৯৬৫) প্রসঙ্গে। বনবিহারীর লেখা দু’টি উপন্যাস ‘যোগভ্রষ্ট’, ‘দশচক্র’ এবং ‘নরকের কীট’, ‘সিরাজির পেয়ালা’র মতো অবিস্মরণীয় ছোটগল্প প্রকাশে তৎপর হলে বনবিহারীই তাঁকে ‘অগ্রসর হতে দেন নাই’ বলে খেদ ছিল সজনীকান্ত দাশের। আক্ষেপ ছিল সৈয়দ মুজতবা আলিরও। বৃদ্ধ বয়সে বনবিহারীর বার বার বাসস্থান পরিবর্তন কষ্ট দিত তাঁকে। চিঠিতে তাই বনবিহারীকে নির্জন বাসস্থান, লাইব্রেরির সুবিধা-সহ মোগলাই-বিলিতি রান্না নিজে রেঁধে খাওয়ানোর কথা লিখেছিলেন, এমনকি ‘সর্বপ্রধান প্রলোভন’ ছিল— বনবিহারীর কনিষ্ঠ ভাই ‘নন্তু’ ওরফে ‘চিত্রকর’ বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের বাসস্থান একেবারে কাছে। আশা ছিল ‘দাসের মতো সেবা করবেন’, ‘সমালোচনা, ব্যঙ্গবিদ্রূপ… তর্কযুদ্ধ করার মত লোকের অভাব হলে আমাকে দিয়েও কিছুটা কাজ চলবে’। উত্তর এসেছিল, “তোমার নিমন্ত্রণ মনে রইল, সময় হলেই আসব।”
বনবিহারীর জন্ম হুগলি জেলার গরলগাছা গ্রামে। পিতা বিপিনবিহারী মুখোপাধ্যায়, মায়ের নাম অপর্ণা। তাঁদের ছয় সন্তানের মধ্যম পুত্র বনবিহারী। বাড়িতে কাব্য, সাহিত্য, চারুকলা, গান, আবৃত্তির চর্চা ছিল। বিনোদবিহারী জানিয়েছেন, মেজদা বনবিহারী পনেরো-ষোলো বছর বয়সেই সংস্কৃতে আদ্য-মধ্য ও কাব্যতীর্থ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সংস্কৃতে অনেক পদ্যও লেখেন। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নাটক-অভিনয়, আবৃত্তিতে জিতেছেন পুরস্কার। বনবিহারী আইএ পরীক্ষা পর্যন্ত ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক পড়েছেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।
মুজতবা আলি জানিয়েছেন, রূপবান বনবিহারীর চুল ছিল কটা, তাঁর গৌরবর্ণ আর অন্য কোনও বাঙালির মধ্যে দেখেননি। আত্মভোলা, স্বার্থহীন, নিরাসক্ত, নির্ভীক বাস্তবের বনবিহারীকে ছবির পর্দায় অবিস্মরণীয় করেছেন মহানায়ক উত্তমকুমার। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) লেখা ‘অগ্নীশ্বর’ অবলম্বনে তাঁর ভাই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সত্তর দশকের সেই ছবি অনেকের দেখা। ‘বেপরোয়া বনবিহারী’ গ্রন্থের লেখক সমীরকুমার ঘোষ যেমন ধর্মেন্দ্র কিংবা শাম্মির ছবি ছেড়ে ছুটেছিলেন হাতিবাগানের সিনেমা হলে। সিনেমায় ‘অগ্নীশ্বর’ আপাত ভাবে কাঠখোট্টা, রূঢ়ভাষী অথচ অসম্ভব মানবিক চিকিৎসক। অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল ও প্রখর। কোনও রকম শৈথিল্য, গোঁড়ামি, ভণ্ডামি, হ্যাংলামি বা অন্যায় ভাবে সুবিধা আদায় অসহ্য ছিল বনবিহারীর। আশৈশব বনবিহারীকে দেখেছেন বনফুল। স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের মতো ছাত্র বনফুলের ‘এক্সারসাইজ বুক’ সংশোধন করে দিতেন, (আত্মস্মৃতি ‘পশ্চাৎপট’), সঙ্গের চিঠিটি হত বেত-তুল্য। জোড়াসাঁকোর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন বনবিহারী এবং প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দর্শনে অগাধ জ্ঞান ছিল। কথার মাঝে উপনিষদ, গীতা, পাতঞ্জল দর্শন, রামায়ণ, মহাভারত, কালিদাস, ভবভূতি থেকে আকছার উদাহরণ দিতে পারতেন। আবার মেডিসিন-সার্জারি, চিকিৎসাশাস্ত্রের উভয় শাখাতেই সমান দক্ষতা ছিল। তখনও কুইনাইন আবিষ্কার হয়নি, এমন সময়ে বনফুল ডবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে বনবিহারীর চিকিৎসা ও পরামর্শেই রক্ষা পান তিনি।
নিজের লেখা প্রকাশিত হলে ‘ফাইল’-এ রাখতেন না বা অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও বলতেন না, আর অচেনা কাগজে প্রায়ই বাছাই লেখা ছদ্মনামে ছাপিয়ে দিতেন। রসসাহিত্যিক ও সম্পাদক পরিমল গোস্বামীকে লেখা চিঠিতে (৫ ডিসেম্বর, ১৯৫৯) তাঁর স্বীকারোক্তি— “আমি কিছু সঞ্চয় রাখি না… অফিশিয়াল খামের পিছনে অর্ডিনারি কালি কলম দিয়ে ছবি এঁকে ছড়িয়ে দিয়েছি। পয়সা চাই নি, অ্যাপ্রিসিয়েশনও ভরসা করিনি।” ‘আমি যাঁদের দেখেছি’ স্মৃতিচিত্রে পরিমলবাবু লিখেছেন, তাঁর সমস্ত সত্তাটি ছিল যেন উচ্চস্তরের দার্শনিকের এবং প্রকাশ ছিল প্রকৃত শিল্পীর। শিল্পী হিসাবে তিনি রচনায় বিশুদ্ধ ব্যঙ্গ অথবা শুধু ব্যঙ্গের ‘টোন’টিকেই সবচেয়ে উপযোগী মনে করেছিলেন, কারণ এ ছাড়া আমাদের সর্বজাতীয় অর্বাচীনতার বিরুদ্ধে তাঁর মনের ক্ষোভ অন্য কিছুতে এমন ভাবে প্রকাশ পেত না। আপসহীন মনোভাবের কারণে কর্মক্ষেত্রে বহু বার বদলি হতে হয়েছে তাঁকে। অবসরের পরে দেহরাদূনের হোটেল, আন্দামান, রামকৃষ্ণ মিশনেও থেকেছেন। ‘স্মৃতির হালখাতা’য় মাতামহ বনবিহারী সম্পর্কে চিকিৎসক-লেখক দেবাশীষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, তিনি তাঁর বড় মেয়েকে স্নেহ-ভালবাসায় কেবল বিয়েই দেননি, নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা, অর্থসাহায্য করা প্রভৃতিও আজীবন করেছেন।
তাঁর ‘নরকের কীট’ গল্প শুরুই হচ্ছে এ ভাবে—
“নরক?— নরকেই ত আছি হে। Been there since 1876… উত্তরে হিমালয় পর্বত, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, হাঁ হাঁ তাই। I mean your— সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং—”
কোনও এক কাল্পনিক শ্রোতা বা বন্ধুস্থানীয় কাউকে সামনে রেখে কথকের এমন একতরফা, অনর্গল, অকপট উক্তিই ‘নরকের কীট’ গল্প। আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষই কুসংস্কারে ভরা নরক, যেখানে আখ-খেজুরের চাষ হওয়া সত্ত্বেও জাভা থেকে চিনি আমদানি বা প্রভূত নদনদী ঘেরা দেশে জলকষ্টের অসঙ্গতি দেখা যায়! মনের এই অবস্থায় আক্রমণ যেন আরও তীব্র হয়— “১২৯৯ সাল থেকে দাসত্ব করে আসচে, অথচ জাতকে জাত সমুদ্রে ডুবে ম’ল না… আজও বংশবৃদ্ধি করচে, আর রেখে যাচ্ছে কতকগুলো হ্যাংলা ক্যাংলা ছেলের পাল, যাদের পেট ভরবে শুধু পীলে আর লিভারে। A colony of maggots in a dungheap (গোবরের স্তূপে যেন পোকার উপনিবেশ)!”
শুধু ‘লেখা’ নয়, তিনি ‘রেখা’তেও সিদ্ধহস্ত। সিনেমায় অগ্নীশ্বরের কার্টুন আঁকার দৃশ্যটি আমাদের চোখে লেগে থাকে। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ব্যঙ্গচিত্র (‘শনিবারের চিঠি’, ‘বিচিত্রা’র ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা’ নামে হারুর চরিত্র জীবনী, বঙ্গবাণীতেও এঁকেছেন)। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে ‘ফোর আর্টস ক্লাব’ হয়ে ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশের একেবারে পিঠোপিঠি সময়ে, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের চৈত্রে ‘সামাজিক এবং বহুবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানসম্মত সাহিত্যিক আন্দোলন’ গড়ে তুলতে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বেপরোয়া’ নামে এক সচিত্র পত্রিকা। মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হলেও অসাধারণ সেই পত্রিকাটি শারদ বা নববর্ষ নয়, ‘ঘেঁটু পুজো’ উপলক্ষে (ঘেঁটু ঠাকুরের উদ্দেশ্যে ‘প্রোদ্দামদীব্যৎখুজুলিচুলকনা’ লেখেন) সংখ্যা প্রকাশ করেছিল— এমনই ছিল রসবোধ। অধ্যাপক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিষ্ণুচরণ ভট্টাচার্যের প্রধান সহযোগী ছিলেন বনবিহারী।
চিন্তার দুর্বলতা, সামাজিক অন্যায়, ধর্ম, কুসংস্কার তাঁর আঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। পরিমল গোস্বামী বলতেন, স্যাটায়ারের ‘রাজা’ বনবিহারী, তেমন যুগ হলে এমন ব্যঙ্গ লেখার দায়ে বাংলায় প্রথম শহিদ হতেন তিনিই। বিশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে শ্লেষ, ব্যঙ্গ, কশাঘাতের ভিতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সাহস ও প্রতিবাদের নতুনতর ক্ষেত্রে প্রবাহের ‘ভগীরথ’ বলা যায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক হরিদাস হালদার, বনবিহারী মুখোপাধ্যায়দের। তাঁরা চিকিৎসার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন সমাজের অন্দরেও।