নাম নিয়ে মনে মনে খানিকটা কিন্তু-কিন্তু থাকলেও নিজের চেহারা সম্পর্কে বেশ গর্বই অনুভব করেছে চপলেশ। চিরকাল।
স্ত্রী পাপড়িও একান্তে চপলেশের সেই অহঙ্কারে ঘি ঢেলেছে।
“কী দেখেছিলে আমার মধ্যে?” চপলেশ জানতে চেয়েছে বিয়ের পর পর।
“ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। তবে সুপুরুষ বলতে ছোট থেকে যেমনটা ভেবে এসেছি, মনে হয়েছে তুমি ঠিক তাই।”
প্রশংসার সেরা প্রশংসা যা বৌয়ের কাছ থেকে পাওয়া যায়!
চপলেশ মিলিয়ে দেখেছে, পাপড়ি নেহাত ভুল বলেনি। চপলেশ মোটা নয়, রোগাও নয়। লম্বাও নয়, বেঁটেও নয়। কালোও নয়, ফর্সাও নয়। কপাল, চোখ, নাক ঠিকঠাক জায়গায়। সঙ্গে একমাথা ঢেউ খেলানো চুল, মন-ভোলানো হাসি আর জোড়া ভুরু তার চেহারায় বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। খুবই আকর্ষক, সন্দেহ নেই।
চল্লিশ পার হতে না হতেই চপলেশের চেহারায় পরিবর্তনটা আসতে শুরু হল চুল দিয়ে। টাক পড়তে শুরু করল। চুল পাকলে কলপ করে সামাল দেওয়া যায়। চুল উঠে গেলে সে উপায় নেই। চুল টেনে সামনে এনে আঁচড়ে গোড়ার দিকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল। এক সময় সামনে আনবে এমন চুলও বাকি রইল না। তখন পরচুলার সন্ধান করবে কি না, সেটাই ভাবতে শুরু করল।
কিন্তু চুল নয়, অন্য যে পরিবর্তনটা সবার চোখে পড়তে লাগল এবং কেউ কেউ বলেও ফেলল, তা হল চপলেশের রোগা হওয়া। মোটা চপলেশ কোনও দিনই নয়, কিন্তু সত্তর কেজি ওজন যখন কমতে কমতে আটান্নয় গিয়ে ঠেকল, তখন চপলেশ নিজেও না ভেবে পারল না।
উপদেশ দেওয়ার লোকজনেরও অভাব হল না। পাপড়ির এক মাসির নাকি এই রকম হঠাৎ ওজন কমতে শুরু করার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা গেল ক্যানসার শরীরে বাসা বেঁধেছে। সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে রোগ। ডায়াবিটিস থেকে থাইরয়েড, টিবি থেকে অন্ত্রের ক্ষত যার যত পরিচিত মানুষ ছিল, এবং যার যার এমন হঠাৎ করে ওজন কমতে শুরু করেছিল, তাদের প্রত্যেকের অসুখের ফিরিস্তি এবং তার ভয়াবহ পরিণতির দীর্ঘ তালিকা রোজ পাপড়ির কাছে জমা পড়তে লাগল।
চপলেশ দেখল, আর অসুখটা ফেলে রেখে কাজ নেই। প্রশ্ন হল আগে ডাক্তার, না আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা? অফিসের টাই-আপ যে বেসরকারি হাসপাতালে, সেখানে ‘হোল বডি চেক-আপ’ বলে একটা বস্তু আছে। পা থেকে মাথা অবধি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হল। পাপড়িও রইল সঙ্গে।
রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে একবর্ণও মাথায় ঢুকল না। রিপোর্ট বগলদাবা করে যাওয়া হল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুর কাছে। দু’মাসের আগে ডাক্তারবাবুর অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না। এক জনকে ধরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করে ডাক্তারবাবু অবধি যখন পৌঁছল এবং তিনি সমস্ত রিপোর্টে চোখ বোলানো শুরু করলেন, চপলেশের মনে হল ফাঁসির আসামিকে যখন জেলের কুঠুরি থেকে বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়, তার অবস্থা চপলেশের মতোই হয়।
মন দিয়ে সমস্ত দেখে ডাক্তারবাবু যখন চপলেশের দিকে চোখ তুলে তাকালেন, তত ক্ষণে চপলেশ নিজের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শোনা রপ্ত করে ফেলেছে।
“খারাপ কিছু?” পাপড়ি জানতে চাইল।
“না তো! সমস্ত রিপোর্ট স্বাভাবিক।”
“তার মানে কিছু হয়নি বলছেন?”
“তা তো বলছি না! বলছি, রিপোর্টে খারাপ কিছুই পাওয়া যায়নি।”
ডাক্তারবাবুর গলায় যে হতাশার সুর, তা চপলেশও বুঝতে পারছিল। রোগী যদি এমন রিপোর্ট নিয়ে আসে, যেখানে খারাপ কিছু নেই, ডাক্তারের তখন কিছু করার থাকে না। হতাশ না হওয়ার কারণ নেই।
ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে মোক্ষম প্রশ্নটা পাপড়িই করল, “তা হলে?”
এত ক্ষণ সেটাই ভাবছিল চপলেশ। টিবি-ডায়াবিটিস-ক্যানসার যা-ই পাওয়া যাক, ওজন কমার একটা কারণ পেয়ে গেলে চিকিৎসাও শুরু করে দেওয়া যায়। কারণ না পেলে তার চিকিৎসা কী ভাবে হবে?
এ সব ক্ষেত্রে আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি পরিবারে যা যা ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা শুরু হয়ে গেল। দুপুরে এক মুঠো ভাত বেশি, রাতে তিনটের বদলে চারখানা রুটি, জলখাবারে দু’খানা করে ডিমসেদ্ধ, সপ্তাহে তিন দিন মুরগির মাংস। ফলে সপ্তাহখানেকের মধ্যে পেট খারাপ, দু’দিন অফিস কামাই করে বসে রইল চপলেশ।
পাপড়ির মাথায় ঢুকল, শুধু খাইয়ে হবে না, দরকার নিয়মিত ব্যায়াম। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিলেন পাপড়ির বড়মামা। এক কালে কোনও এক আখড়ায় ব্যায়াম করতে যেতেন। এখনও বাইসেপস দেখলে ঈর্ষা হয়।
তিনিই বাইসেপস ফুলিয়ে পাপড়ির মাথায় ঢোকালেন, “আজকাল তো আর যোগব্যায়ামের আখড়া নেই, আছে জিম। পাড়ায় পাড়ায় জিম খুলে গিয়েছে। তারই কোনওটায় ভর্তি করে দাও।”
যেমন ভাবা, তেমনই কাজ।
কাছাকাছি একটা জিমের সন্ধান পাওয়া গেল। একগাদা টাকা জমা দিয়ে ভর্তিও হয়ে এল চপলেশ। জিমের ইনস্ট্রাকটর জানতে চাইলেন অসুখের হাল-হকিকত, তার পর এক্সারসাইজ় বেঁধে দিলেন। পাশাপাশি চলল নির্ধারিত ডায়েট।
দু’সপ্তাহের মাথায় অফিস থেকে ফেরার সময় রাস্তায় কাত হয়ে পড়ে গেল চপলেশ। কপাল ভাল, কোনও গাড়ির চাকার নীচে চলে যায়নি। গেলে ক্যানসার নয়, অপঘাতে প্রাণ যেত। ধরাধরি করে সবাই কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে গেল।
সেখানে ডাক্তারবাবু প্রেশার মাপতে গিয়ে আঁতকে উঠলেন, “কী সাংঘাতিক! প্রেশার যে ভীষণ কমে গিয়েছে।”
কেন কমেছে, কী তার ব্যাকগ্রাউন্ড, চপলেশের চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।
পাপড়ি সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। লাভের মধ্যে জিমে যাওয়া বন্ধ হল চপলেশের।
তবে আসল যে অসুখ, ওজন কমে যাওয়া, তার কোনও সুরাহা হল না।
*****
গাছের তলায় একা একা বসে ভাবছিল চপলেশ। গয়না বারো ক্লাস পাশ করল। এ বার কলেজ। এখন সব অনলাইন। অ্যাপ্লিকেশন থেকে সিলেবাস, ভর্তি, সমস্ত কিছু। পেয়েও গেছে মেয়েটা। তাও পাপড়ি বলল, “কো-এডুকেশন কলেজ, ভর্তি করার আগে এক বার দেখে তো এসো। কেমন পরিবেশ, এক বার চোখের দেখাও দেখবে না?”
পাপড়ির কথায় যুক্তি আছে। একটাই তো মেয়ে। বাড়ির বাইরে প্রথম বেরোবে। কোথায় থাকবে, ক্যাম্পাস কেমন, এক বার নিজে গিয়ে দেখে আসতে ক্ষতি কী! সুযোগমতো এক দিন অফিস ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
কলেজে এসে কিন্তু চোখ জুড়িয়ে গেল। বিশাল ক্যাম্পাস। পিছনে ছেলেদের আর মেয়েদের হস্টেল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। উপরে যাওয়ার নিয়ম নেই। গেস্ট রুমে বসে অপেক্ষা। যার জন্য অপেক্ষা, সে গেস্ট রুমে নেমে এলে তবে কথাবার্তা। একতলাতেই ডাইনিং হল। জলখাবার থেকে রাতের খাবার, সব কিছুরই বন্দোবস্ত হস্টেলের ভিতরেই।
তবে অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এও ক্যান্টিন আছে। চাইলে সেখানেও খেয়ে নেওয়া যেতে পারে। বাইরে থেকে যেটুকু দেখা যায়, ক্লাসরুমগুলো বড় বড়, আলো-হাওয়ার অবাধ চলাচল। শহরের ভিতরে নয়। আবার শহর ছাড়িয়ে অনেক দূর, ফাঁকা মাঠের মধ্যে তা-ও নয়। সব মিলিয়ে ব্যবস্থা বেশ ভালই লাগল চপলেশের।
অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। এক পাশে ফুলের বাগান। অন্য পাশে বড় বড় গাছ— শিমুল, অশ্বত্থ। দু’দিন আগে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। গাছের ভাঙা ডাল, ঝরে পড়া পাতা এখনও ডাঁই হয়ে আছে। একটা গাছের ছায়ায় বসে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের দেখতে দেখতে কখন যেন ভাবনাটা অন্য দিকে বয়ে যেতে শুরু করেছে, টের পায়নি চপলেশ।
কত বয়স ছেলেগুলোর? আঠারো থেকে বাইশ-তেইশ। শক্তসমর্থ চেহারা। অনেকেই ব্যায়াম-ট্যায়াম করে বোঝা যাচ্ছে। হাতের মাস্ল, চলাফেরা, সব কিছুতে আত্মবিশ্বাস যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে।
ক’বছরেই চপলেশ কেমন বদলে গেল! ক’দিন আগে রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। গেঞ্জিটা খুলে টাঙিয়ে দিয়েছিল হুকে। তার পর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখেছিল।
গালদুটো ঢুকে গিয়েছে ভিতরে। চোয়ালের হাড় সামনে বেরিয়ে এসেছে। দু’খানা লিকলিকে হাত শরীরের দু’পাশে কাকতাড়ুয়ার হাতের মতো ঝুলছে। পাঁজরাগুলো গুনে ফেলা যাচ্ছে। মুখটা শুকিয়ে যাওয়ায় কানদুটো হাতির কানের মতো লটপট করছে। চপলেশের হাসি দেখেই ফ্ল্যাট হয়ে গিয়েছিল পাপড়ি। আয়নার চপলেশের দিকে তাকিয়ে হাসল চপলেশ। মনে হল হাসি নয়, কেউ দাঁত খিঁচোচ্ছে। তাড়াতাড়ি আলো নিবিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
গাছের ছায়া, ঠান্ডা হাওয়া, গয়নাকে ভাল জায়গায় ভর্তি করতে পারার প্রশান্তি, সব মিলিয়ে কখন যেন চোখ জড়িয়ে এসেছিল চপলেশের। ঘুম ভেঙে গেল তীব্র চিৎকারে।
“বাঁচাও, বাঁচাও! মেরে ফেলল!”
ধড়মড় করে উঠে বসল চপলেশ। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে যা হয়, কোথায় আছে, কোথা থেকে চিৎকার, বুঝে উঠতে সময় লাগে। সামনে তাকাতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল।
মোরাম বিছানো রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর দিকে ঘুরেছে, ঠিক সেইখানে আউটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে। তার হাতে একটা ছুরি পড়ন্ত বেলার আলোয় চকচক করছে। মেয়েটার সাদা চুড়িদার রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। ছেলেটার হাত উঠছে-নামছে আর প্রত্যেক বার আঘাতের সঙ্গে মেয়েটার আর্ত চিৎকার ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাসের প্রত্যেক প্রান্তে। কিন্তু শুধু এটুকুই নয়। যা দেখে চপলেশ স্তম্ভিত হয়ে গেল, অনেকেই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এই দৃশ্য দেখে তাড়াতাড়ি ওই জায়গাটা পার হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ খানিক দূর এগিয়ে শেষটুকু দেখার লোভ সংবরণ করতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কেউ আবার মোবাইলে ওই দৃশ্য সংরক্ষণ করে রাখতে ক্যামেরা তাক করছে। অথচ কেউই মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসছে না। চপলেশ লক্ষ করল এদের প্রত্যেকেই পুরুষ, যাদের বয়স আঠারো থেকে বাইশ।
ভিতরে কী যেন একটা ভাঙচুর হয়ে গেল চপলেশের।
হাতের কাছেই পড়েছিল একটা মোটামতো ভাঙা ডাল। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। পৌঁছে গেল একদম কাছে। তত ক্ষণে আর এক বার আঘাত করার জন্য হাত তুলেছে ছেলেটি। গায়ে যত জোর ছিল, তা জড়ো করে ভাঙা ডালখানা দিয়ে সেই হাতে আঘাত করল চপলেশ। হাত চেপে ধরে বসে পড়ল আততায়ী। ছুটে এল দর্শকদের মধ্য থেকে দু’-চারজন। এক জন জাপটে ধরল ছেলেটিকে, এক জন মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর দিকে।
*****
পুলিশ-টিভি-খবরের কাগজের লোকজন-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব-প্রতিবেশী-পরিচিত-অপরিচিত— ক’টা দিন যেন ঘোরের মধ্য দিয়েই কেটে গেল। একই কথা বলতে বলতে জিভ শুকিয়ে যেতে লাগল চপলেশের। প্রথমে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট দিচ্ছিল। শেষকালে শুধু চা দেওয়া শুরু করল পাপড়ি। গয়না তো এমনটাও বলল, এন্ট্রি ফি-এর ব্যবস্থা রাখলে কলেজে অ্যাডমিশনের খরচ উঠে যেত।
দিন পনেরো পর সমস্ত থিতিয়ে যেতে এলেন পাপড়ির বড়মামা। রবিবার। স্নান করতে যাবে বলে বারান্দায় বসে গায়ে সর্ষের তেল মাখছে চপলেশ। বড়মামা ঢুকলেন। পিছন পিছন তাঁর আদরের ভাগনি পাপড়ি।
কিছু একটা বলতে বলতে আসছিলেন, কিন্তু চপলেশকে দেখে বড়মামার কথা বন্ধ হয়ে গেল।
বড়মামা পরে এসেছেন তাঁর প্রিয় হাফহাতা সাদা ফতুয়া। ফতুয়ার দু’পাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে মুগুরের মতো দু’খানা ব্যায়াম করা হাত, হাতের পাকানো মাস্ল।
সামনে চপলেশ, খালি গা, দু’পাশে লিকলিকে দু’খানা হাত লটপট করছে। আড়চোখে সে দিকে তাকালেন বড়মামা। কিন্তু বেশি ক্ষণ তাকাতে পারলেন না। চোখ নামিয়ে চলে গেলেন ভিতরে।
ছবি: কুনাল বর্মণ