মারাত্মক গতিতে মুখোমুখি ছুটছে দু’টি গাড়ি। ধাক্কা লাগল বলে। কিন্তু তবুও দু’জনেই ছুটছে এই আশায় যে, অন্য গাড়িটি গতি সংযত করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে। যে পাশ কাটিয়ে পালাবে সে ভিতু, আর যে বেরোবে না সে হবে জয়ী। গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্বতত্ত্বের ভাষায় একে বলে গেম অব চিকেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সারা বিশ্বের বিরুদ্ধে শুল্ক-যুদ্ধ চরিত্রে অনেকটা এই রকম। তার মূল কথা: আমি তোমার উপরে আমদানি শুল্ক বসিয়ে তোমাকে নিঃস্ব করে দেব তুমি যদি আমার রফতানিতে শুল্ক না কমাও। এ খেলার ঝুঁকি হল, এমন পরিস্থিতি হতে পারে যে, কেউই শুল্ক কমাল না এবং সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হল। আর একটি সম্ভাবনা হল, যে বেশি তেড়েফুঁড়ে আসছে, তাকে সমীহ করে অন্য দেশটি শুল্ক কমাল। তৃতীয় সম্ভাবনা হল, দু’পক্ষেরই শুভবুদ্ধির উদয় হল, এবং কেউই কারও পণ্যের উপরে চড়া শুল্ক বসাল না— বাণিজ্যের বাজার আবার কল্লোলিনী তিলোত্তমা হল। তৃতীয় পরিস্থিতিটি বাস্তবে রূপায়ণ এবং স্থিতিশীল করতে দরকার সহযোগিতা আর আলোচনা, যা বর্তমান ভূ-রাজনীতিতে হওয়া কঠিন।
২ এপ্রিল স্বঘোষিত সেই ‘লিবারেশন ডে’-তে একটি বড় বোর্ড দেখিয়ে ট্রাম্প সারা বিশ্বকে হুমকি দিয়েছিলেন, কোন দেশের উপরে কত শুল্ক ধার্য হবে। জানিয়েছিলেন, সেই বর্ধিত হারে শুল্ক চালু হবে ৯ এপ্রিল। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শেয়ারের দাম পড়তে শুরু করল। ট্রাম্প বিচলিত হলেন না, কারণ তিনি জানেন যে, শেয়ার বাজার অনেক সময় ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়। তার পর ডলারের দাম পড়তে শুরু করল। এতেও প্রেসিডেন্ট ঘাবড়ালেন না। এপ্রিলের ৯ তারিখ বন্ডের বাজারে অনেকে আমেরিকান বন্ড বেচতে শুরু করলেন, ফলে সেই ঋণপত্রের দাম হ্রাস পেতে শুরু করল। ট্রাম্প এ বার নড়েচড়ে বসলেন— নতুন শুল্ক চালু করার দিন প্রায় তিন মাস পিছিয়ে দিলেন। ঘটনা হল, আজ অবধি সেই বোর্ডে-লেখা শুল্কগুলি বলবৎ হয়নি, শুধুমাত্র ১০% পারস্পরিক ভূমিরেখা শুল্ক ছাড়া।
তবে বিভিন্ন দেশ ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতে বসতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ভারত আমেরিকা থেকে আমদানি করা হুইস্কি আর জিনের উপরে শুল্ক অর্ধেক কমিয়েছে। চিন সম্প্রতি আমেরিকার উপরে শুল্ক ১০% ধার্য করেছে, যেটি ২০১৮ সালের ধার্য হার ২০ শতাংশের অর্ধেক। পরিবর্তে আমেরিকা ৩০% শুল্ক ধার্য করবে বলছে। আমেরিকার সমগ্র রফতানির প্রায় ১৪% চিনে। চিনেরও রফতানির ১৪% আমেরিকাতে। এই শুল্ক-যুদ্ধে উভয়েরই ক্ষতির সম্ভাবনা। কিন্তু চিনের রফতানির বাজার বিপুল, যার মধ্যে প্রচুর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ আছে। সুতরাং এই বাণিজ্য যুদ্ধে চিনের শক্তিও কম নয়। তা সত্ত্বেও চিন আমেরিকাকে সমঝে চলছে, কারণ কোনও দেশই চায় না যে, শুল্ক-যুদ্ধের চোটে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাক। ট্রাম্প কি তা হলে এই ‘গেম অব চিকেন’-এ জিতছেন?
এর উত্তর পাওয়া এই মুহূর্তে কঠিন। উল্লেখ্য, আমেরিকার ঋণপত্রের দামে পতন শুরু হতেই ট্রাম্প শুল্ক-যুদ্ধে পিছু হটেছিলেন। আমেরিকান বন্ড হল একটি ঝুঁকিহীন সঞ্চয় প্রকল্প। সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা কিছু আমেরিকান ঋণপত্র তাঁদের সঞ্চয়ের বাক্সে রেখে দেন এই আশ্বাসে যে, আমেরিকান সরকারের তহবিলে কখনও লালবাতি জ্বলবে না। সেই ঋণপত্রের মূল্যহ্রাস আর তার সঙ্গে ডলারের দাম কমা এই সঙ্কেতই দিচ্ছে যে, বাজার আমেরিকান ঋণপত্র এবং ডলারের উপরে আস্থা হারাচ্ছে। এর সঙ্গে ট্রাম্পের আয়কর কমানোর নীতি যোগ করলে, আমেরিকার বাজেটে আরও ঘাটতি বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। বাইরের বিনিয়োগকারীদের কাছে আমেরিকার ঋণপত্র এখন তাই আগের মতো ঝুঁকিহীন নয়।
দ্বিতীয়ত, ঋণপত্রের দাম হ্রাস পাওয়া মানে সুদের হার বৃদ্ধি। সম্প্রতি ত্রিশ বছরের মেয়াদের ঋণপত্রের উপরে সুদ প্রায় ৫% হয়ে গেছে। সুদ যদি এ ভাবে বাড়তে থাকে, তা হলে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগ কমবে, কারণ যে সব বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্ক ঋণের উপরে নির্ভর করেন, তাঁদের বেশি সুদ দিতে হবে। ট্রাম্প ফেডারাল রিজ়ার্ভ-এর প্রধান জেরোম পাওয়েলকে চাপ দিচ্ছেন শীর্ষ সুদের হার কমাতে। তবে, ফেডারাল রিজ়ার্ভ-এর আইনগত স্বাধীনতা আছে প্রেসিডেন্টের কথায় কর্ণপাত না করার। মূল্যবৃদ্ধি এখনও হয়নি। তবে কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সুপারমার্কেট, যেমন ওয়ালমার্ট, যেখানে আমদানি দ্রব্য বেশি বিক্রি হয়, নতুন শুল্ক বসলেই দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
যদিও দাম না বাড়ানোর জন্য স্টোরের মালিকদের চোখ রাঙাচ্ছেন, চড়া শুল্ক কার্যকর হলে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা যাবে না। সুতরাং ট্রাম্প চাপের মধ্যে আছেন। চিন ছেড়ে এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে নিশানা করছেন।
অন্য দিকে, যুদ্ধ বন্ধ না করলে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে, এই ধরনের হুমকি দিয়ে তিনি ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত বন্ধ করেছেন বলে ট্রাম্প দাবি করছেন। সুতরাং বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে ট্রাম্প বহু দূর এগোনোর কথা ভাবছেন। সময়ই বলবে এই পদ্ধতি কতটা কার্যকর।