জওয়ান ঝন্টু আলি শেখ, নদিয়ার সন্তান। পহেলগাম সন্ত্রাসবাদী হামলার পরবর্তী লড়াইয়ে উধমপুর সীমান্তে শহিদ হলেন। ঝন্টুর মৃত্যুর খবর পেয়ে মিডিয়া ধরল তাঁর বাবাকে। কাঁদতে কাঁদতে বাবা বললেন, এ বার বিশ্বাস হল তো, আমরা কোন পক্ষে?
মনখারাপ হয়েছিল খুব। আমরা কি পিছোতে পিছোতে এমন কোথাও পৌঁছে গেলাম, যেখানে এক জন সংখ্যালঘু মানুষের ক্ষেত্রে, নিজেরই দেশকে ভালবাসার প্রমাণ দিতে গেলে, শহিদ হওয়ার মতো চরম পরিণতি ছাড়া উপায় রইল না আর? প্রাত্যহিক, স্বাভাবিক দেশপ্রেম— তা কি গ্রাহ্য করা বন্ধ হয়ে গেল? হরবখত সশব্দে জানান দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে গেল যে, এই দেখো, আমি তোমাদেরই এক জন, আমাকে একঘরে করে দিয়ো না?
তার পরও কি ঝন্টু আলি সবার কাছে সমান শ্রদ্ধার, সমান ভারতীয় হতে পারলেন? তাঁর কফিনবন্দি মরদেহ যখন গ্রামে প্রবেশ করছে, সকলে গেল শ্রদ্ধা জানাতে, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল ছাড়া। দু’দিন পর সে দলের স্থানীয় নেতার ফোন রেকর্ডিং ফাঁস হল, “ওখানে তো মোল্লা মরেছে, আমাদের গিয়ে কী লাভ?” (আনন্দবাজার পত্রিকা এই রেকর্ডিংয়ের সত্যতা যাচাই করেনি) ঝন্টুর আর মরেও ‘ভারতীয়’ হয়ে ওঠা হল না। অবশ্য ঝন্টুর চেয়ে বহু গুণ উচ্চপদস্থ কর্নেল সোফিয়া কুরেশিই বা ‘সন্ত্রাসবাদীদের বহেন’ তকমা এড়াতে পারলেন কই!
‘রাষ্ট্রবাদ’-এর ঠিকাদাররা এখন নিক্তি মেপে ‘দেশপ্রেম’-এর ওজন বাতলাচ্ছে ভারতে। কেবলমাত্র ভারতে কেন, প্রায় গোটা ভারতীয় উপমহাদেশেই। কোথাও জামাটা সবুজ, কোথাও গেরুয়া। ফারাক এটুকুই। উড়ছে আজও ধর্ম-ধ্বজা, টিকির গিঁটে দাড়ির ঝোপে।
সমস্যা ধর্মে নয়, সমস্যা সাম্প্রদায়িকতায়। উগ্র দক্ষিণপন্থীদের চিরদিনের পছন্দের হাতিয়ার অপরায়ণ। জনগণের সামনে একটা কল্পিত শত্রু হাজির করে তার বিরুদ্ধে দা-কোদাল সমেত নেমে পড়ো। আমাদের উপমহাদেশের ক্ষেত্রে, জাতপাতের মতোই, ধর্মও অপরায়ণের অন্যতম শক্তিশালী বাহন। আমাদের দীর্ঘ ইতিহাসে বেড়ে ওঠা হিন্দু ধর্মের বিবিধ প্রবাহের সঙ্গে আরএসএস-প্রচারিত উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী নারীবিদ্বেষী ‘হিন্দুত্ব’র পরতে পরতে যোজন ফারাক। স্বয়ং সাভারকরের লেখায় পাওয়া যায়, ‘হিন্দুত্ব’ একেবারেই একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। আরএসএস-বিজেপি যে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানাতে চায়, তা একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের রূপ, তার সঙ্গে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’-এর বিশেষ যোগাযোগ নেই। ধার্মিক মানুষদেরও তাই, এই উন্মত্ততার বিরুদ্ধেই অবস্থান নেওয়া উচিত।
গৈরিক জাতীয়তাবাদীরাও জানে, আমাদের এই বিপুল বৈচিত্রের সমাজ— যাকে অতুলপ্রসাদ চিত্রায়িত করেছিলেন বিবিধের মাঝে মহান মিলনের মাটি রূপে— তা ওদের একশৈলিক রাজনৈতিক প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। কাজেই, এই বৈচিত্রের অন্তর্গত সহজাত ঐক্যের উপাদানটিকে ক্ষতবিক্ষত করার কোনও সুযোগ সেই উগ্রতার রাজনীতি ছাড়ে না। বাস্তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে যুদ্ধে হারানোর চেয়েও ওদের কাছে বেশি জরুরি যুদ্ধ-সংক্রান্ত উন্মাদনাকে ব্যবহার করে, দেশের ভিতরে ভিন্নমত পোষণকারীদের ‘অপর’ হিসাবে চিহ্নিত করা, কোণঠাসা করা। শুধু সংখ্যালঘুরাই নয়, সমাজের অ-সাম্প্রদায়িক যুক্তিবাদী অংশটিও ভীষণ ভাবে এই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। যাঁরা যুক্তির উপরে ভর করে যুদ্ধের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের এক বার কোনও মতে যদি দেশের বিরোধী হিসাবে প্রতিপন্ন করে দেওয়া যায়, ব্যস! কেল্লা ফতে!
আমরা কেউ সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এতটুকু ঢিলে দেওয়ার পক্ষে নই। এবং এ নিয়েও বিন্দুমাত্র সংশয় নেই যে, যদি কোনও রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদকে লালনপালন করে, তার থেকে আত্মরক্ষা করার অধিকারও অবশ্যই আমাদের সেনাবাহিনীর আছে। প্রশ্ন হল, শুধুমাত্র আক্রমণ-প্রতিআক্রমণে কি এ-হেন দৈত্যাকার সমস্যার নিরসন সম্ভব? কূটনৈতিক পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করার ক্ষেত্রে কত দূর সফল হলাম আমরা, বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বঘোষিত (এবং যথেষ্ট অপমানজনক!) মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা, ও তা সম্বন্ধে ভারত সরকারের হিরণ্ময় নীরবতা দেখে এ প্রশ্ন ওঠে বইকি। পহেলগামে আক্রমণকারী জঙ্গিরা আজও ধরা পড়ল না, এ দিকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শেষে তালিবানদের বন্ধু ঠাওরাতে হচ্ছে আমাদের, এ দৈন্য কিসের ইঙ্গিত— এ-হেন উদ্বেগের উদ্রেক মোটেই দেশদ্রোহের লক্ষণ নয়, সঙ্গত কথাই বটে।
যাঁরা ‘শান্তি চাই’ বলে মিছিল করলেন, তাঁরা সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি কোনও প্রকার দুর্বলতা থেকে তা সংগঠিত করেননি। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের যুদ্ধ লাগলে তা তো কেবল সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না— ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনপদ, বাজারহাট, অফিস-কাছারি। হতাহত হবেন নিরপরাধ আমজনতা। বিদেশনীতিতে যে কৃষকের বিন্দুমাত্র ভূমিকা ছিল না, পুড়ে ছাই হবে তাঁর ধানের গোলাও। যে দেশ ২০২৪ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে দুনিয়ার ক্ষুধার্ততম ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৫তম স্থানে রয়েছে, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে যুদ্ধে শামিল হয়ে যাওয়া তার সাজে কি?
এ প্রসঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান, জেনারেল মনোজ নরবণের বক্তব্য বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই গণ-জিঘাংসার আবহেই তিনি দেশবাসীর কাছে আবেদন করেছেন: যুদ্ধ কোনও সিনেমা নয়, যুদ্ধকে রোমান্টিসাইজ় করবেন না। একান্ত উপায় না থাকলে যুদ্ধ করতে হয়, তবে কূটনীতির রাস্তা পরিত্যাগ করে নয়, প্রথম পছন্দ হিসাবে সে পথই শ্রেয়। শুনছিলাম, আর ভাবছিলাম, যাক, ‘সেকু-মাকু’দের দলে ইনিও যোগ দিলেন তবে। দেখা যাক, কবে রাষ্ট্রবাদীরা তাঁকেও গণপিটুনি দিয়ে পাকিস্তানে ফেলে আসার নিদান দেয়!
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে বিশ্ব রাজনীতিতে সন্ত্রাসবাদকে মদত দেয় যারা, বা যারা এই বিপুল অস্ত্রব্যবসা থেকে লাভবান হয়, তাদের উপর চাপ তৈরি করা জরুরি। ভারত সরকার সে কাজ সফল ভাবে করুক, আমরা সকলে চাইব। দেশের ভিতরে সমস্ত ধরনের সন্ত্রাসবাদকে বিচ্ছিন্ন করতে দেশের জনগণের ঐক্য সংহত মজবুত হোক, চাইব তা-ও। ‘সমস্ত ধরনের সন্ত্রাসবাদ’ কথাটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রজ্ঞা ঠাকুররা দেখিয়ে দিয়েছেন, যে কোনও ধর্মকে অজুহাত হিসাবে খাড়া করেই সন্ত্রাসবাদী হওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িকতা হল উগ্র দক্ষিণপন্থার প্রিয়তম বর্ম। তারই নৃশংস, নির্মমতম রূপ হল সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ। সুতরাং এর উৎস, অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে মোকাবিলা না করে, জাত-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ঐক্য গড়ে না তুলে, স্রেফ প্রতিহিংসার জিগির তুলে এই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব নয়।
বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের আত্মাকে রক্ষা করতে হবে। সংস্কৃতির, ভাবনার সযত্নলালিত বৈচিত্রকে উদ্যাপন করতে হবে। যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনাকে বার বার এই ঘৃণাবিদ্বেষের ব্যাপারীদের সামনে ঢাল হিসাবে তুলে ধরতে হবে। পরীক্ষায় প্রথম হয়ে যে মেয়েটি সাহস করে ‘রিলিজন’-এর জায়গায় ‘হিউম্যানিটি’ লিখল, অথবা, পহেলগাম জঙ্গিহানায় সদ্যবিবাহিত সেনা অফিসার স্বামীকে হারানোর পর যে যুবতী বললেন, সব মুসলিম বা সব কাশ্মীরিকে দোষ দেবেন না— তাঁরা যাতে উন্মত্ত ট্রোলবাহিনীর আক্রমণের মুখেও মাথা উঁচু করে হক কথাটা বলতে পারেন আজীবন, তেমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। খুব সহজ কাজ নয়। তবে, অসম্ভবও নয়।
ফ্যাসিবাদীরা উগ্র জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমকে গুলিয়ে দিতে চাইবে। সাম্প্রদায়িক অন্ধত্বকেই ভারতীয়ত্ব বলে চালাতে চাইবে। বোঝানোর চেষ্টা করবে, এক দেশের গরিব মানুষ পড়শি দেশের গরিব মানুষকে ভালবাসতে পারে না। ওরা ঝগড়া লাগিয়ে দেবে ছাপোষা ঘরের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে। তার পর বলবে, শহিদ ঝন্টু আলি শেখ ভারতীয় নয়, নেহাতই মুসলমান!
আমাদের কাঁধে গুরুদায়িত্ব, ইতিহাসের পাতায় শহিদ ঝন্টুর ‘ভারতীয়’ পরিচিতিকে প্রশ্নাতীত করার। রাস্তা লম্বা ঠিকই, তবে সুখের কথা, পথ জনহীন নয়। কঠিন পথেও হাঁটছেন অনেক মানুষ। হাতে আম্বেডকরের সংবিধান, মুখে রবি ঠাকুরের গান। আমরা হাঁটছি শান্তির জন্য, সম্প্রীতির জন্য, শস্যের সুষম বণ্টনের আশায়। “এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।”