ছুটির মাসুল
‘ছুটির অনুদান’ (৫-৫) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। জনমানসে প্রশ্ন উঠছে, এত ছুটি কেন? আমরা গ্রীষ্মপ্রধান রাজ্যের বাসিন্দা। উত্তরের চারটি জেলা ছাড়া বাকি সব ক’টিতেই মে মাসে গরম থাকে। তাপপ্রবাহ এ রাজ্যে নতুন কোনও ঘটনা নয়। সে কথা মাথায় রেখেই স্কুল কলেজে গ্রীষ্মকালীন ছুটির ব্যবস্থা করা হয়। সেই অবধি ঠিক থাকলেও, সমস্যা হয় ছুটি দীর্ঘায়িত হলে। সরকারের যুক্তি, এতে তাপপ্রবাহজনিত ক্ষয়ক্ষতির ভয় থাকে না। ফলে ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। তবে এর পরোক্ষ লাভও কম নয়। স্কুল ছুটি থাকলে পর্যটন লাভবান হয়। তল্পিতল্পা বেঁধে নিয়ে বাঙালিরা সামর্থ্য অনুযায়ী বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন। এবং আশ্চর্য ভাবে, সেই বেড়ানোয় গরমের কোনও প্রভাব পড়ে না। দ্বিতীয় লাভটি আসে মিড-ডে মিল থেকে। বর্তমানে রাজ্যে প্রায় এক কোটি ছাত্রছাত্রী স্কুলে দুপুরের খাবার খায়। এর জন্য ত্রিশ দিনে যে বিপুল পরিমাণ খরচ হয়, তার ৬০ শতাংশ আসে কেন্দ্র থেকে এবং বাকি অংশ বহন করে রাজ্য সরকার। দীর্ঘ দিন ছুটি থাকার অর্থ এই বিপুল ব্যয়ভার থেকে খানিক অব্যাহতি পাওয়াও বটে।
কিন্তু এ লাভের চক্করে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা, যারা মূলত পড়াশোনার জন্য স্কুলের উপরেই নির্ভর করে, এবং যাদের গৃহশিক্ষকের ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা নেই। সর্বভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল রাখতে এখন রাজ্যের স্কুলপাঠ্য বইগুলিও বিপুল তথ্যে সমৃদ্ধ, এবং সেগুলি নিবিড় পাঠ ও অনুশীলনের দাবি রাখে, যা দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত অনুশীলন ছাড়া রপ্ত করা বেশ কষ্টসাধ্য। দীর্ঘ ছুটিতে তাই এই সব দরিদ্র ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যাদের বাড়িতে নজর দেওয়া হয় বা দক্ষ গৃহশিক্ষক যাদের ভাগ্যে জোটে, তারাই কেবল সিলেবাসের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে সক্ষম হয়।
এ দিকে, সরকারি দফতর থেকে বিদ্যালয়ে ‘সামার প্রোজেক্ট’-এর নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। তা বেশ বিজ্ঞানসম্মতও। সেখানে দলবদ্ধ ভাবে কাজ, নেতৃত্বদান, স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা, সামাজিক সচেতনতা, বাস্তব জগতে সমস্যার সম্মুখীন হওয়া— প্রভৃতি বিষয়ে সক্ষমতার বিকাশ ঘটানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নিরন্তর নজরদারি ছাড়া এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব কি?
গত বছরের দীর্ঘ গ্রীষ্মাবকাশ পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের আরও পিছিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে একাদশ-দ্বাদশের বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক না থাকায় ভুগতে হচ্ছে বিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রী— সকলকেই। সরকারি ‘কম্পোজ়িট গ্রান্ট’ নিয়মিত ও যথাযথ না আসায় স্কুলগুলি ভীষণ ভাবে আর্থিক সঙ্কটে দীর্ণ। এই সমস্যা থেকে মুক্তির আপাত উপায় আছে দু’টি। প্রথমত, দুপুরের পরিবর্তে সকালে স্কুলের আয়োজন করলে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা যেমন অব্যাহত থাকে, তেমনই তাপপ্রবাহ থেকেও সুরক্ষিত থাকতে পারে তারা। দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়গুলিতে ব্যাপক ভাবে বৃক্ষরোপণ করলে তা বিদ্যালয়ের পরিবেশকে ছায়ার শীতলতায় ভরিয়ে দিতে পারে। এমনই উপায় আছে আরও। চাই কেবল বাস্তবায়নের সদিচ্ছা।
পার্থ পাল
মৌবেশিয়া, হুগলি